Monday, July 16, 2012

মাধবকু-ের সাতকাহন


শাহীন আহমেদ
মাধবকু-। সারা এক প্রাণবন্ত জলঝর্ণার নাম। এর অবস্থান মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখা থানার পাথারিয়া বনাঞ্চলে। ১৬২ ফুট উঁচু আদম আইল বা পাথারিয়া পাহাড় থেকে খাড়াভাবে অবিরাম জলপ্রপাতের ফলে সৃষ্ট কু--মাধবকু-। পাহাড়ি পল্লবে ঘেরা ঝিঝি পোকার গুঞ্জনে মুখরিত এ অবস্থানে জলরাশির অবিরাম ধারাপতনের শব্দে শান্তিতে ভরে যায় মন। যে ট্রিলার গা বেয়ে পানি পড়ছে তার পুরোটাই পাথুরে। তাছাড়া নিচে ছড়িয়ে আছে বিরাট পাথররাজি, যা দর্শনার্থীদের হৃদয় আকৃষ্ট করে। মাধবকু- এখন পর্যটন কেন্দ্র। আগে বছরে একবার পুন্যার্থীরা এলে এখানে মেলা বসত। এখন রোজই বসে মেলা। সারাদেশ থেকে রোক আসে। গড়ে উঠেছে অনেক দোকান পাঠ। কু-ে ভাসছে নৌকা। পাড়ে চড়ছে ঘোড়া। জায়গাটা এখন ফটো তোলার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। পর্যটনের পাকাবাড়ি উঠেছে। মানুষের হাত পড়েছে প্রকৃতির গায়ে। ছড়ানো বোল্ডারে নানাজনের নাম ঠিকানা লেখা। চড়–ইভাতির নিয়মিত শৌখিন সফর জায়গাটাকে অনেক বেশি প্রাণবন্ত করে তুলেছে। দূর থেকে মাধবকু-ের মূল স্পটকে অনেকটা গুহার মত মনে হয়। এখানে নির্ঝরের ঝরঝর, পত্র-পল্লবের মৃদুমর্মর, চেনা-অচেনা পাখির একটানা কুজন ঝর্ণার জলের সোদা সোদা গন্ধ। গাছের তলায় বসলে শীত শীত করে।

মাধবকু-ের ইতিহাস
কমলাকান্ডগুপ্তের হট্টনাথের পাঁচারীর ব্রহ্মাঞ্চল খ- থেকে ‘জনশক্তি’ নামক সাপ্তাহিক (অধুনালুপ্ত) পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধে উল্লেখ আছে-সিলেটের শেষ হিন্দু রাজা গঙ্গাধ্বজ পাথারিয়া পাহাড়ে একটি বিশ্রামাগার নির্মাণ শুরু করলে মাটির নিচে এক ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীকে দেখতে পান। তখন তিনি ওই সন্ন্যাসীর পদবন্দনা শুরু করেন। সন্ন্যাসী তাকে বলেন, মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশ তিথিতে ওই কু-ে তাকে যেন বিসর্জন দেওয়া হয়। রাজা সন্ন্যাসীর আজ্ঞা পালন করেন। তখন মাধব, মাধব, মাধব বলে তিনবার দৈবরাণী হয়। তা থেকে এর নামকরণ হয় মাধবকু-। কু-ের ডানপাশে পাথরের গায়ে একটি গুহার সৃষ্টি হয়েছে। গুহাটিকে স্থানীয় ভাষায় কাব বলা হয়। কাব দেখলে মনে হবে পাহাড়ের গায়ে কেউ যেন বহুযতেœ খোদাই করে রেখেছে পাথরের একটি চালাঘর। অথচ এটি প্রাকৃতিক। বৃষ্টির সময় এ কাব এর নিচে প্রায় দুশতাধিক লোক দাঁড়াতে পারবে। মধুকৃষ্ণ ত্রয়োদশ তিথিতে সআনার্থীরা কার্বের নিচে দাঁড়িয়ে ভেজা কাপড় পরিবর্তন করে থাকেন। কথিত আছে নাগবাবা নামের একজন সন্ন্যাসী স্বপ্নে দৃষ্ট হোন যে মাধবেশ্বর শিব তাকে বলছেন-‘আমি কু-ের মধ্যে শত শত বছর যাবত নিমজ্জিত আছি! আমাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা কর,’ তারপর নাগাবাবা সেই শিবলিঙ্গ ঝর্ণার ঠিক পেছনের উঁচু অংশে স্থাপন করেন এবং এটিই এখন শিব মন্দির নামে পরিচিত। এখন নিয়মিত পূজা অর্জনা চলে এখানে। মাধবকু-ের একটু দূরে শিবলিঙ্গ তীর্থের অবস্থান। মূলকু- থেকে অর্ধকিলোমিটার দূরে চৈত্রশুক্লা প্রতিপদে পূজারাীগণ পূজো করতে এখানে আসেন। প্রাকৃতিক দৃশ্য হিসেবে শিবলিঙ্গ তীর্থও একটি দর্শনীয় স্থান।

বাঘ সিংহ মন্দির
১৯৬৭ সালে বাঘ সিংহ মন্দির নির্মাণ করা হয়। এর নির্মিাতা কন্টইনাথ। এ মন্দিরের বারান্দায় একটি বাঘ ও একটি সিংহের প্রতিকৃতি আছে। মন্দিরের চৌকাঠে খোদাই করে লেখা আছে ‘ও নম : শিবায়। দাসো ওহং শবমাগত : করুনয়া বিশ্বেশ্বরপ্রাহি মাং।

আরো আছে কু-
মাধব কু- থেকে প্রায় এক মাইল উপরে রয়েছে আরো একটি ছোট কু- ও বৃহৎ পাথর খ-। সুবৃহৎ এই পাথর খ-টি ছড়ার এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত সমান স্থান জুড়ে আছে। দৃশ্য দেখতে হলে দর্শনার্থীদের কষ্ট করে উপরে উঠতে হবে।

আধ্যাত্মিক পুরুষ
পুরীবাবা
অতীতে মাধবকু- এলাকায় বেশ কয়েকজন গৃহত্যাগী সন্নাসী সাধনা করতে আসেন। এ সন্নাসীদের মধ্যে রামানন্দপুরী প্রাচীনতম। তিনি পুরী বাবা নামে পরিচিত ছিলেন। পুরী বাবা ১৩২০ বঙ্গাব্দে মাধবকু-ের গভীর বনে আসেন এবং কৃত্রিম শিবলিঙ্গ স্থাপন করে পূজা অর্জনা শুরু করেন। কথিত আছে মাধবকু-ের যেখান দিয়ে জল পড়ে সেখান দিয়ে তিনি খড়ম পায়ে যাওয়া আসা করতেন।

নাগাবাবা
পুরীবাবার মৃত্যুর পর নাগাবাবা নামের একজন সন্নাসী শিব পূজার দায়িত্ব নেন। তিনি এ কু-ের গভীর জঙ্গলের মধ্যে বাস করতেন।

চুড়া থেকে মাধবকু-
১৬২ ফুট উপর থেকে মাধবকু-ের ঝর্ণার জল পড়ে। পাহাড় বেয়ে সেই চুড়ায় পৌঁছানো সম্ভব। ওখান থেকে দেখা যায় আরেক দৃশ্য। মানুষগুলো যেন পুতুল, আর প্রমোদতরীটি যেন খেলনা। হাতি তার শুড় দিয়ে পানি ছিটালে যেমন দেখায়, জলপ্রপাতের পতনশীল পানিও যেনো তেমনি ছিটকে পড়ছে। মুষলধারায় বৃষ্টি হলে যেমন দেখায়, তার শতগুণ বেগে জলরাশি পড়ছে অহনিশি।

মাধবছড়া
মাধবকু-ের চোখের জলে একটি নদী বয়ে গেছে। স্থানীয়ভাবে একে ‘মাধবছড়া’ বলে। বর্ষায় কুল ছাপিয়ে বন্যার ঢল নামে। বৈশাখ মাসে থাকে হাটু জল। এই মাধবছড়া পশ্চিম দিকে হাকালুকি হাওরে গিয়ে মিশেছে।

বারুনী
চৈত্র মাসের মধুকুষ্ণা ত্রয়োদশ তিথিতে মাধবকু-ের বারুনী øান ও প্রায় দুই মাইল পশ্চিমে সনাতনপুরের বড়বন্দে ঐতিহ্যবাহী বারুনী মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বারুনী উপলক্ষে এক সময় ভারতের হরিদ্বার লক্ষেèৗ, গয়া প্রভৃতি অঞ্চল থেকে সাধু-সন্নাসীরা আসতেন। এদের অনেকে ছিলেন দীর্ঘ জটাধারী। বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরাও আসতেন।

মৃত্যু
মাধবকু-ে অনেকের মৃত্যু ঘটেছে। ১৯৮৭ সালে বারুনী øানে এসে ১৫ বছর বয়সী হাইস্কুলের ছাত্র অসিতবরণ পালের মৃত্যু ঘটে। শত শত øানার্থীর ভীড়ে প্রায় হাঁটুজলে সে অন্তর্হিত হয়। এছাড়া বছর কয়েক আগে সিলেট মেডিকেল কলেজের একজন ছাত্র নির্মমভাবে এখানে মৃত্যুবরণ করেন। তার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ভেষজ ওষুধ
মাধবকু-ের পাহাড়ে বেড়ে ওঠা লতাপাতা ভেষজ ওষুধ হিসেবে খুবই উপকারী। কাটাকুটিতে এন্টিসেপটিক হিসেবে পিচাশ পাতা বা গাদা ফুলের রস, কচুর কস, পেটের যে কোন পীড়ায় ভাদালি, থানকুনি, পুদিনা রুপজট প্রভৃতি পাতার ঝোল, র্দি কাশিতে বাসক ও তুলসির রস, ব্যাথা পেলে আকন্দ পাতার গরম সেক, হাড় ভাঙলে হাড় জোড়া পাতার প্রলেপ। বাতের ব্যাথা বা ফোলায় ডনকলসের পাতার সঙ্গে লবণ ও চুন মিশিয়ে পিষে প্রলেপ দেওয়া, জ্বরে চিরতা বিভানো পানি, পেটের ব্যাথায় এক পাত্তির রস, কৃমি হলে নিমপাতার ভাজি বা রস, চর্ম রোগে নিম পাতা সিদ্ধ পানিতে øান-খুবই উপকারী। মাধবকু-ে এক সময় জনবসতি ছিল না। কু-ের চারদিকে ছিল ঘন অরণ্য। তারপর ধীরে ধীরে আসতে থাকে শিলং, ডাউকি, জৈন্তিয়া ও জাফলং থেকে অভিবাসিত আদিবাসী খাসিয়া, উড়িষ্যা ও বিহার থেকে আগত চা শ্রমিক কুলি। আর মনিপুর ছেড়ে আসে মুনিপুরী। এই নিয়েই মাধবকু-ের জনবসতি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে লোকালয়। এই সব তথ্য জানালেন স্থানীয় এমদাদ, লুৎফুর ও আরেফ আহমেদ।

বদলে যাচ্ছে মধাবকু-
মাধবকু-ের পাথুরে সড়কে ইট বিছানো হয়েছে। পিচ পড়েছে। পর্যটকরা গাড়ি চালিয়ে সশব্দে মাধবকু-ে যাচ্ছেন। মাধবকু-ের পাখির কলরব ও বাতাসের আওয়াজ এখন নিশান পেট্টোল, পাজেরো, টয়েটা প্রভৃতি গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে প্রায় চাপা পড়ে যাচ্ছে। টেম্পুওয়ালারাও আছে। তারা টু-স্ট্রোক ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে ধোঁয়া। দালান উঠছে। দোকান বসেছে। সব কিছু বদলাচ্ছে। খাসিয়া কুলিরাও বদলে যাচ্ছে।

শেষ কথা
মাধবকু- যেমন দর্শনীয় স্থান, তেমনি একটি তীর্থস্থানও বটে। মাধবকু-ের ঘন অরণ্য কেটে সাফ করছে বনদস্যুদের দল। রাষ্ট্রযন্ত্রের নির্ধারিত হেফাজতকারীরা আছেন। কিন্তু তাদের সাধ্য নেই এ অপকর্ম ঠেকাবার। এ নিয়ে স্থানীয়দের আফসোসের শেষ নেই। স্থানীয় হরিপুরের বাসিন্দা কমান্ডার ইব্রাহিম আলীর ভাষায় তা ফুটে উঠল।

কিভাবে যাবেন
বাংলাদেশের যে কোন স্থান থেকে এখানে রেলপথ বা সড়কপথে আসার ব্যবস্থা রয়েছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে আন্তঃনগর ট্রেনে কুলাউড়া জংশন পর্যন্ত আসতে পারেন, কুলাউড়া থেকে সড়ক পথে মাধবকু-ে যাওয়ার জন্য রয়েছে প্রাইভেট গাড়ি ও বাস চলাচল করে। পর্যটক ও ভ্রমণকারীদের সুবিধার্থে জলপ্রপ্রাতের প্রায় আধামাইল পশ্চিমে রয়েছে একটি ডাকবাংলো। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে সেখানেও থাকা যায়। পর্যটন হোটেলে পাওয়া যায় রুচি সম্মত খাবার-দাবার।

No comments:

Post a Comment