শাহীন আহমেদ
সূর্যাস্তের আগেই মাধবকুন্ডে আঁধার নামে। জলমর্মর নৈঃশব্দের গভীরতা বাড়ায়। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই আছে খাসিয়াদের পুঞ্জি। পানের জুমক্ষেত। পাখারিয়া পাহাড়ের বুক কেটে বাসযোগ্য করেছেন খাসিয়ারা। গড়েছেন বসতি। খাসিয়া পুঞ্জি দেখতে অপূর্ব ও নৈসর্গিক। পুঞ্জি পৌঁছুতে চোখে পড়ে ঘন অরণ্য। সবুজ পত্রপল্লবিত গাছাগাছালি। দুটি পাতা একটি কুঁড়িতে ভরা চা বাগান। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে শর্পিল পিচঢালা পথ। মাধবকু-ের চোখের জলে বয়ে যাওয়া ছড়ার (ছোট নদী) ছড়ার পাশে অভিবাসিত আদিবাসী খাসিয়াদের অবস্থান। খাসিয়া পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ পথে লেখা আছে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। আমরা বিপাকে পড়লাম। সহযোগিতা চাইলাম স্থানীয় দুজন বাঙালির। এগিয়ে এলেন লক্ষ্মীছড়া সনাতনপুর গ্রামের মাসুক আহমেদ ও আবদুল হামিদ। তাদের সহযোগিতায় আমরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। বসলাম মন্ত্রীর ঘরে। মন্ত্রীর গেস্টরুম মন্ত্রিত্ববিহীন। ১টা বড় টেবিল চার থেকে পাঁচটা চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাবপত্র নেই। তিনি পুঞ্জিতে নেই। আছেন দূরে কোথাও। কেউ জানে না। মাসুক, হামিদ ছোটাছুটি করে ম্যানেজ করলেন বয়োবৃদ্ধ একজন খাসিয়াকে। নাম মিদরিন ছুরান। বয়স আনুমানিক ৮৫ বছর। বয়স তাকে ন্যুজ্ব করেনি। বেশ প্রাণবন্ত। তিনি এগিয়ে এলেন। বসতে দিলেন আনুমানিক ছয় ইঞ্চির ছোট পিঁড়িতে। মিদরিন বেশ হাসিখুশি, কথা বলতে পারেন ঢাকার শুদ্ধ বাংলায়। আঞ্চলিক আর নিজের ‘খাসি’ ভাষায়। বললেন- আমাদের একজন প্রধান আছেন। তাকে আমরা মন্ত্রী বলি। সবকিছুতে তার আনুগত্য করি। এই মন্ত্রী হন বংশানুক্রমে। একজন থেকে আরেকজন। মাধবকু-ে কিভাবে মানববসতি গড়ে উঠল। এ এক বিস্ময়। খাসিয়ারা জংগল পরিষ্কার করেছেন। করেছেন বাসযোগ্য, চাষযোগ্য। জানতে চাইলাম পুরনো দিনের কথা। মিদরিন ছুরানের চোখ চকচক করতে লাগল। আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন। এখানে এক সময় গভীর জঙ্গল থেকে হুটহাট করে বাঘ চলে আসত। সবাই মিলে বাঘ প্রতিহত করেছি। মেরেছি। আরও মেরেছি পণ্য শূকর, শৃগাল, শাপ এবং বন্য জানোয়ার। এইসব হিংস্র বন্য পশুদের হাতে তাদের অনেক মারাও গেছেন। জীবনের বলিদানে খাসিয়া জীবন এখানে থেমে থাকেনি। বরং তা আরও বেড়েছে। বর্তমানে এখানে আছে ৮৫টি খাসিয়া পরিবার। লোকসংখ্যা পাঁচশ’রও অধিক। প্রধান পেশা পান চাষ। এই পানের খ্যাতি আছে সিলেট থেকে শুরু করে বিলেত পর্যন্ত। কলাগাছ আছে অনেক। পরিচর্যা করতে হয় না। এমনিতেই অনেক। ফলে তা নিজেরা খায় এবং বিক্রিও করে। নিবু নিবু বিকেল। এই সময়ে খাসিয়ারা ব্যস্ত সময় কাটান। সবাই পান সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন। সাঁঝের আগেই ঘরে ফেরেন। ছেলেরা গাছ থেকে পান পাড়েন। মেয়েরা ঝুড়িতে করে তা ঘরে নিয়ে আসেন। কর্মঠ প্রায় সব খাসিয়াদের হাতে একটা করে দা থাকে। নাম টাখলি দা। মেয়েরা পানের গুছি করেন। ১২টি পানে এক গুছি। ১২ গুছিতে ১ গোটা। ২০ গোটায় ১ কুড়ি। এক কুড়ির দাম সাতশ থেকে ১ হাজার টাকা। শেষ বিকেলে মিদরিন ছুরানের সংসারের সবাই ঘরে ফিরলেন। সাথে পানের ঝুড়ি। হাতে টাখলি দা নিয়ে। চেহারায় কোনও ক্লান্তি নেই। খাসিয়া মেয়েরা খুব লাজুক। লাজ ভাঙতে একটু সময় লাগল। আমাদের আসার একে একে যোগ দিলেন সুতানা মুকসর, প্রসপার মুকসর, জনি মুকসর, পলি ও প্রীতি মুকসর। মজার বিষয় সবার নামের শেষ অংশটা মায়ের নাম।
খাসিয়া সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা। খাসিয়া পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। প্রবাদ আছে লংজেইদ না কিন থেই (নারীদের হাতে মানবজাতির উৎপত্তি)। মেয়েরা ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী। পরিবারের ছোট মেয়ের ধনসম্পদে প্রাধান্য বেশি। বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। খাসিয়া সমাজে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আছে। এ জন্য বেশিরভাগ বিয়ে হয় প্রেম করে। বিয়ের ক্ষেত্রে কথাবার্তা পাকা হলে ডিম ভাঙা পদ্ধতির দ্বারা শুভ অশুভ ফলাফল নির্ধারিত হয়। বিয়ের পর পুরুষকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়। স্বগোত্রে বিবাহ খাসিয়া সমাজে নিষিদ্ধ। শ্বশুরবাড়িতে পাঁচ বছর থাকার পর স্বামী স্ত্রী অন্যত্র থাকার সুযোগ পায়। বিয়ে হয় খ্রিস্টান পদ্ধতিতে। বিয়ের পর ভোজ হয়। ভোজ দেন কনের মা। এইটুকু বলে মিদরিন ছুরানের বৌ ভেতর ঘরে গেলেন। খানিকবাদে একজগ ভর্তি রঙ চা নিয়ে এলেন। শুধু মিদরিনের জন্য আলাদা বাঁশের মগ। খাসিয়াদের দেহের রঙ ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট চোখ উন্নত চিবুক, দাঁড়ি গোফের স্বল্পতা ইত্যাদি তাদের দৈহিক বেশিষ্ট্য। মেয়েরা দেখতে বড়ই মায়াবতী। একহারা গড়ন। øিগ্ধ, শান্ত, স্লিম। উঁচু টিলা উঠানামাই এই স্লিম দেহের মূল কারণ। খাসিয়া নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। এরা সবাই কর্মী। প্রাণবন্ত, প্রাণচঞ্চল ও স্বতঃস্ফূর্ত। খাসিয়াদের বিয়ে বা পূজা পার্বণসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ গাচ থাকবেই। এরা সবাই ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথিতে বড় দিনে পালিত হয়। পুঞ্জিতে হয় মূল অনুষ্ঠান। আয়োজন হয় নাচ, গান আর প্রার্থনার। অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় কা নাকড়া (ঢোল) কা মরিনাম (হারমোনিয়াম) কা দুইকারার (গিটার) কা শারতি (বাঁশি) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। তার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হলেও পূজো করেন প্রকৃতির এবং বিভিন্ন দেবদেবীর। তাদের বিশ্বাস উব্লাই নাথউ ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা বলেলেন জনডাফরিন। পুঞ্জিতে আছে ১টি স্কুল। খাসি’ ভাষা এবং রোমান হরফে সেখানে শিক্ষাক্রম চলে। চার্চ আছে দুটি। ক্যাথলিক এবং রোমানদের আলাদা। তবে ফাদার নেই। ফাদার আসেন বড় দিনে কুলাউড়ার মিশন থেকে।
আমরা কথা বলছি মিদরিনের ঘরের দাওয়ায় বসে। এটি সমতল ভূমিথেকে আনুমানিক দুইশ ফুট ওপরে। এখানে বসে দেখা যাচ্ছে মাধবকু-ে গড়ে উঠেছে ট্যুরিজম। হোটেল-মোটেল। জায়গাটা আজকাল আর দুর্গম নয়। ঘন বন পাতলা হয়ে এসেছে। ট্যুরিস্টরা আসছেন ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা জাতের গাড়ি হাঁকিয়ে। রীতিমত বিপ্লব। মাধবকু-ের উন্নয়ন হলেও খাসিয়া জীবনে এর কোনও প্রভাব পড়েনি।
পুঞ্জির সবকিছু ছিমছাম। সাফসুতরা। এখানে বসে মাধবকু-ের ঝর্নার জলগর্জন শুনা যায়। পুঞ্জির ঘর-বাড়ি অনেকটা ভুটানি আদলে নির্মিত। দু-একটা ঘর আছে ঐতিহ্যের স্মারক। সমতল ভূমি থেকে তিন চার হাত উপরে তৈরি, বাঁশের ঘর। আর বাদবাকি সবই ইট-পাথরের। পুঞ্জির মেয়েরা নিজেদের তৈরি পোশাক পরে। কিন্তু পুরুষরা প্যান্ট-শার্ট পরা। আধুনিক, স্মার্ট। পুঞ্জি থেকে নিচে চোখ ফেললেই বক ধড়ফড় করে ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে রয়ে গেছে ছোট মাধবছড়া। খাসিয়াদের বৌ-ঝিরা এখানে øান থেকে শুরু করে বাসনকুশন ধোয়ামুছা সবই করে। তবে পানি পান করেন একদম ফ্রেশ। মিনারেল ওয়াটার। এই খাবার পানি আসে মাধবকু-ের চূড়া থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে। পানি আসে সারাদিন-সারাবছর।
গল্পের আসর সাঙ্গ করে আমরা বিদায় নেই। পাহাড়ি জনপদ ভেঙে নিচে নামি। সঙ্গে মিদরিন ছুরানের পুরো পরিবার। হাতে হ্যাজাক লাইট। এ যেন আপনজনকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে।
সূর্যাস্তের আগেই মাধবকুন্ডে আঁধার নামে। জলমর্মর নৈঃশব্দের গভীরতা বাড়ায়। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই আছে খাসিয়াদের পুঞ্জি। পানের জুমক্ষেত। পাখারিয়া পাহাড়ের বুক কেটে বাসযোগ্য করেছেন খাসিয়ারা। গড়েছেন বসতি। খাসিয়া পুঞ্জি দেখতে অপূর্ব ও নৈসর্গিক। পুঞ্জি পৌঁছুতে চোখে পড়ে ঘন অরণ্য। সবুজ পত্রপল্লবিত গাছাগাছালি। দুটি পাতা একটি কুঁড়িতে ভরা চা বাগান। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে শর্পিল পিচঢালা পথ। মাধবকু-ের চোখের জলে বয়ে যাওয়া ছড়ার (ছোট নদী) ছড়ার পাশে অভিবাসিত আদিবাসী খাসিয়াদের অবস্থান। খাসিয়া পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ পথে লেখা আছে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। আমরা বিপাকে পড়লাম। সহযোগিতা চাইলাম স্থানীয় দুজন বাঙালির। এগিয়ে এলেন লক্ষ্মীছড়া সনাতনপুর গ্রামের মাসুক আহমেদ ও আবদুল হামিদ। তাদের সহযোগিতায় আমরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। বসলাম মন্ত্রীর ঘরে। মন্ত্রীর গেস্টরুম মন্ত্রিত্ববিহীন। ১টা বড় টেবিল চার থেকে পাঁচটা চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাবপত্র নেই। তিনি পুঞ্জিতে নেই। আছেন দূরে কোথাও। কেউ জানে না। মাসুক, হামিদ ছোটাছুটি করে ম্যানেজ করলেন বয়োবৃদ্ধ একজন খাসিয়াকে। নাম মিদরিন ছুরান। বয়স আনুমানিক ৮৫ বছর। বয়স তাকে ন্যুজ্ব করেনি। বেশ প্রাণবন্ত। তিনি এগিয়ে এলেন। বসতে দিলেন আনুমানিক ছয় ইঞ্চির ছোট পিঁড়িতে। মিদরিন বেশ হাসিখুশি, কথা বলতে পারেন ঢাকার শুদ্ধ বাংলায়। আঞ্চলিক আর নিজের ‘খাসি’ ভাষায়। বললেন- আমাদের একজন প্রধান আছেন। তাকে আমরা মন্ত্রী বলি। সবকিছুতে তার আনুগত্য করি। এই মন্ত্রী হন বংশানুক্রমে। একজন থেকে আরেকজন। মাধবকু-ে কিভাবে মানববসতি গড়ে উঠল। এ এক বিস্ময়। খাসিয়ারা জংগল পরিষ্কার করেছেন। করেছেন বাসযোগ্য, চাষযোগ্য। জানতে চাইলাম পুরনো দিনের কথা। মিদরিন ছুরানের চোখ চকচক করতে লাগল। আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন। এখানে এক সময় গভীর জঙ্গল থেকে হুটহাট করে বাঘ চলে আসত। সবাই মিলে বাঘ প্রতিহত করেছি। মেরেছি। আরও মেরেছি পণ্য শূকর, শৃগাল, শাপ এবং বন্য জানোয়ার। এইসব হিংস্র বন্য পশুদের হাতে তাদের অনেক মারাও গেছেন। জীবনের বলিদানে খাসিয়া জীবন এখানে থেমে থাকেনি। বরং তা আরও বেড়েছে। বর্তমানে এখানে আছে ৮৫টি খাসিয়া পরিবার। লোকসংখ্যা পাঁচশ’রও অধিক। প্রধান পেশা পান চাষ। এই পানের খ্যাতি আছে সিলেট থেকে শুরু করে বিলেত পর্যন্ত। কলাগাছ আছে অনেক। পরিচর্যা করতে হয় না। এমনিতেই অনেক। ফলে তা নিজেরা খায় এবং বিক্রিও করে। নিবু নিবু বিকেল। এই সময়ে খাসিয়ারা ব্যস্ত সময় কাটান। সবাই পান সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন। সাঁঝের আগেই ঘরে ফেরেন। ছেলেরা গাছ থেকে পান পাড়েন। মেয়েরা ঝুড়িতে করে তা ঘরে নিয়ে আসেন। কর্মঠ প্রায় সব খাসিয়াদের হাতে একটা করে দা থাকে। নাম টাখলি দা। মেয়েরা পানের গুছি করেন। ১২টি পানে এক গুছি। ১২ গুছিতে ১ গোটা। ২০ গোটায় ১ কুড়ি। এক কুড়ির দাম সাতশ থেকে ১ হাজার টাকা। শেষ বিকেলে মিদরিন ছুরানের সংসারের সবাই ঘরে ফিরলেন। সাথে পানের ঝুড়ি। হাতে টাখলি দা নিয়ে। চেহারায় কোনও ক্লান্তি নেই। খাসিয়া মেয়েরা খুব লাজুক। লাজ ভাঙতে একটু সময় লাগল। আমাদের আসার একে একে যোগ দিলেন সুতানা মুকসর, প্রসপার মুকসর, জনি মুকসর, পলি ও প্রীতি মুকসর। মজার বিষয় সবার নামের শেষ অংশটা মায়ের নাম।
খাসিয়া সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা। খাসিয়া পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। প্রবাদ আছে লংজেইদ না কিন থেই (নারীদের হাতে মানবজাতির উৎপত্তি)। মেয়েরা ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী। পরিবারের ছোট মেয়ের ধনসম্পদে প্রাধান্য বেশি। বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। খাসিয়া সমাজে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আছে। এ জন্য বেশিরভাগ বিয়ে হয় প্রেম করে। বিয়ের ক্ষেত্রে কথাবার্তা পাকা হলে ডিম ভাঙা পদ্ধতির দ্বারা শুভ অশুভ ফলাফল নির্ধারিত হয়। বিয়ের পর পুরুষকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়। স্বগোত্রে বিবাহ খাসিয়া সমাজে নিষিদ্ধ। শ্বশুরবাড়িতে পাঁচ বছর থাকার পর স্বামী স্ত্রী অন্যত্র থাকার সুযোগ পায়। বিয়ে হয় খ্রিস্টান পদ্ধতিতে। বিয়ের পর ভোজ হয়। ভোজ দেন কনের মা। এইটুকু বলে মিদরিন ছুরানের বৌ ভেতর ঘরে গেলেন। খানিকবাদে একজগ ভর্তি রঙ চা নিয়ে এলেন। শুধু মিদরিনের জন্য আলাদা বাঁশের মগ। খাসিয়াদের দেহের রঙ ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট চোখ উন্নত চিবুক, দাঁড়ি গোফের স্বল্পতা ইত্যাদি তাদের দৈহিক বেশিষ্ট্য। মেয়েরা দেখতে বড়ই মায়াবতী। একহারা গড়ন। øিগ্ধ, শান্ত, স্লিম। উঁচু টিলা উঠানামাই এই স্লিম দেহের মূল কারণ। খাসিয়া নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। এরা সবাই কর্মী। প্রাণবন্ত, প্রাণচঞ্চল ও স্বতঃস্ফূর্ত। খাসিয়াদের বিয়ে বা পূজা পার্বণসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ গাচ থাকবেই। এরা সবাই ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথিতে বড় দিনে পালিত হয়। পুঞ্জিতে হয় মূল অনুষ্ঠান। আয়োজন হয় নাচ, গান আর প্রার্থনার। অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় কা নাকড়া (ঢোল) কা মরিনাম (হারমোনিয়াম) কা দুইকারার (গিটার) কা শারতি (বাঁশি) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। তার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হলেও পূজো করেন প্রকৃতির এবং বিভিন্ন দেবদেবীর। তাদের বিশ্বাস উব্লাই নাথউ ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা বলেলেন জনডাফরিন। পুঞ্জিতে আছে ১টি স্কুল। খাসি’ ভাষা এবং রোমান হরফে সেখানে শিক্ষাক্রম চলে। চার্চ আছে দুটি। ক্যাথলিক এবং রোমানদের আলাদা। তবে ফাদার নেই। ফাদার আসেন বড় দিনে কুলাউড়ার মিশন থেকে।
আমরা কথা বলছি মিদরিনের ঘরের দাওয়ায় বসে। এটি সমতল ভূমিথেকে আনুমানিক দুইশ ফুট ওপরে। এখানে বসে দেখা যাচ্ছে মাধবকু-ে গড়ে উঠেছে ট্যুরিজম। হোটেল-মোটেল। জায়গাটা আজকাল আর দুর্গম নয়। ঘন বন পাতলা হয়ে এসেছে। ট্যুরিস্টরা আসছেন ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা জাতের গাড়ি হাঁকিয়ে। রীতিমত বিপ্লব। মাধবকু-ের উন্নয়ন হলেও খাসিয়া জীবনে এর কোনও প্রভাব পড়েনি।
পুঞ্জির সবকিছু ছিমছাম। সাফসুতরা। এখানে বসে মাধবকু-ের ঝর্নার জলগর্জন শুনা যায়। পুঞ্জির ঘর-বাড়ি অনেকটা ভুটানি আদলে নির্মিত। দু-একটা ঘর আছে ঐতিহ্যের স্মারক। সমতল ভূমি থেকে তিন চার হাত উপরে তৈরি, বাঁশের ঘর। আর বাদবাকি সবই ইট-পাথরের। পুঞ্জির মেয়েরা নিজেদের তৈরি পোশাক পরে। কিন্তু পুরুষরা প্যান্ট-শার্ট পরা। আধুনিক, স্মার্ট। পুঞ্জি থেকে নিচে চোখ ফেললেই বক ধড়ফড় করে ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে রয়ে গেছে ছোট মাধবছড়া। খাসিয়াদের বৌ-ঝিরা এখানে øান থেকে শুরু করে বাসনকুশন ধোয়ামুছা সবই করে। তবে পানি পান করেন একদম ফ্রেশ। মিনারেল ওয়াটার। এই খাবার পানি আসে মাধবকু-ের চূড়া থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে। পানি আসে সারাদিন-সারাবছর।
গল্পের আসর সাঙ্গ করে আমরা বিদায় নেই। পাহাড়ি জনপদ ভেঙে নিচে নামি। সঙ্গে মিদরিন ছুরানের পুরো পরিবার। হাতে হ্যাজাক লাইট। এ যেন আপনজনকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে।
No comments:
Post a Comment