chobi:homayed ishak moon.BTEF |
এবার পাহাড়ে নাকি থইথই জোছনা দেখা যাবে। সেই জোছনায় ভেসে যাবে বন, গ্রাম, নদী, জনপদ। জোছনার নৃত্য দেখতে আমরা কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। সেদিন ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা। পরের দু’দিনও ছুটি। জোছনা দেখতে এবার রাঙামাটির বিলাইছড়ির উজানে ফারুয়া ছেড়ে পানছড়ি পর্যন্ত যাব। ১৩ জনের দল। রাতে ঢাকা থেকে শ্যামলী বাসে রওনা দিয়ে কাপ্তাই পৌঁছালাম ভোরে। বাস কাউন্টার-লাগোয়া রেস্টুরেন্টে নাশতা খেয়ে নৌকা ঘাটে যাই। নৌকা সমিতির বুলবুল ভাইয়ের সহযোগিতায় একটি ভালো ট্রলার পাওয়া গেল। ট্রলারে ওঠার আগে দরকারী কেনাকাটা করে নেন জিলানী ভাই।কাপ্তাই লেকের কচুরীপানা আর বাঁশের চালি ঠেলে এগিয়ে চলে ট্রলার। নাসির মাঝি একাই একশ’। ট্রলার কাপ্তাই লেক ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁক নিয়ে ঢুতে গেল ছোট্ট একটি খালে। নাম রাইক্ষং। পাহাড় সারির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে খাল। বৃষ্টিধোয়া পাহাড় আজ দারুণ সতেজ। সবাই ভিড় করলাম ট্রলারের ছাদে। দলে তবলা, করতালের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে গিটার। গানের দল গলা ছেড়ে দিল। গাইড বঙ্কিম তঞ্চঙ্গ্যাকে ফোন করতেইতিনি বললেন, আসুন। আমি সকাল থেকেই আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।বিলাইছড়ি বাজারে যখন নৌকা ভেড়ে তখন দুপুর। তেলাপিয়ার ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ট্রলার ছোটাই আরো উজানে। সবুজ পাহাড় থেকে এখন ভ্যাবসা গরম আসছে। গরমের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আমরা ট্রলারের ভেতরে ঢুকে পড়ি। অনেকেই ভাতঘুম দেয়। বিকেলের দিকে ঠা-া বাতাস ছাড়ে। বৃষ্টিও আসবে মনে হয়। ফারুয়া এখনও অনেক দূর। রাত হওয়ার আগেই পৌঁছানো দরকার। দ্রুত ট্রলার চালিয়েও খুব একটা সুবিধা হলো না। সন্ধ্যা নেমে এলো। তারপরও ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুদূর গিয়ে মাঝিকে বলি, Ñও ভাই, রাত যে হয়ে গেলো, ফারুয়া কই? মাঝি যা উত্তর দেয় তাতে ঠিক দিশা পাওয়া যায় না। এক জায়গায় এসে হঠাৎই থেমে যায় ট্রলার। খটকা লাগে। টর্চ হাতে অনেক মানুষ দেখতে পাই। বঙ্কিমদা বলেন, খালে বৃষ্টির পানিতে অনেক মাছ এসেছে। জাল দিয়ে মাছ ধরছে এরা। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই মেতেছে মাছ ধরার উৎসবে। বেশ লাগল।
ইতোমধ্যে আকাশে রুপালি চাঁদ উঠেছে। সাদা মেঘের দল সেই চাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার আমাদের চলা শুরু হলো। বেশ রাত করে আমরা পৌঁছাই ফারুয়া বাজারে। বাজারে খাবার বলতে পাওয়া গেল ঠা-া ভাত, আলুভর্তা আর ডাল। চাইলে ডিম ভাজা পাওয়া যাবে। দোকানী জানালেন, মাছ আছে। তবে রান্না হতে অনেক সময় লাগবে। শেষমেষ ডোবা তেলে মাছ ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না আর ভাত বসানোর সিদ্ধান্ত হলো।দোকানী লেগে যান রান্নার কাজে। আর আমরা জমে যাই গল্পে। চিনি কম দুধচা আর খাজা (গজা) খেয়ে একপাক চক্কর দিতে বের হই ‘এল’ সাইজের ফারুয়া বাজারটা। ভরা জোসনায় বাজারের আশপাশের পাহাড় সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বাজারে একটি হিন্দু মন্দিরও আছে। ফারুয়া বাজার ঘুরে ফিরে এসে পেটপুরে মাছভাত খাই। ভরা পেটের আমেজে আবারো খেয়াল করি আকাশ ভেঙেজোছনা নেমেছে। দোকানপাট, গাছপালা, খালের জল, কাপড়চোপসব জোছনা ধোয়া সাদা। চারদিক অন্ধকার থাকয় জোসনা আরো তিব্র হয়েছে, যা বর্ণনার সাধ্য আমার নেই। সাবই গোল হয়ে বসি ট্রলারের ছাদে। জোছনার আলোয় চলতে থাকে গান।খুব ভেরে ঘুম ভাঙে। হাতে তেমন কাজ নেই। বাজারে যাই, ঘোরাঘুরি করি, নাশতা খাই। এতক্ষণে আকাশে যে মেঘদল
উড়োউড়ি করছিল তা এখন বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে ফারুয়া বাজারে। টানা চার ঘণ্টা চলে বৃষ্টি হলো। হঠাৎ খেয়াল করি পাহাড়ি ঢল নামেছে খালে। অল্প সময়েই খাল ভরে গেল। খালে প্রচ- স্রোত। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে আমরা খালের ওপারে যাই। এখানে বঙ্কিমদার বাড়ি ও দোকান। জায়গাটি খুব সুন্দর! পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর, অনেক খোলা জায়গা। ওপরে বৌদ্ধ মন্দির। দারুণ পরিবেশ।
বেলা বাড়তে থাকে। ফেরার সময় হয়ে আসে। পাহাড়ি ঢল নেমে গেলে পাশের খালের পানি শুকিয়ে যাবে তাই ট্রলার রেখে ছোট দু’টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে ফারুয়া বাজার ছেড়ে রওনা হই। এই বাজারের পরে আর কোনো বাঙালি বসতি নেই। আমরা পানি উজিয়ে আস্তে আস্তে চলি।
এভাবে একসময় গোবাছড়ি, চেংড়াছড়ি হয়ে চলে যাই পানছড়ি। তখন বিকেল নেমেছে। ঝর্নায় গোসল করি দলবেঁধে। তারপর একটা দোকানে গাছপাকা পাহাড়ি মিষ্টি কলা, বেলা বিস্কুট ও চা খাই। অন্ধকার নামার আগেই ফিরে আসি চেংড়াছড়ি পাড়ায়। কারবারির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। এর মধ্যে বড় দু’টি মোরগ নিয়ে আসে একজন। ২০০ টাকা কেজি দরে একটি কিনে নেই আমরা। নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাইক্ষং খালের উপর কারবারী আমাদের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ করেন। ঘরের লোকজন গেছে জুম চাষে। তার মানে এই রাতে আমরাই ঘরের মালিক। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। আমাদের চিফ শেফ হোমায়েদ ইসহাক মুন মোরগ নিয়ে রান্না করতে যায়। ওয়াকিল ভাই গিটার বাজিয়ে গান ধরেন। গলা মেলান সামির ভাইÑ সখি কুঞ্জ সাজাওগো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’। আমাদের গান শুনতে পাড়ার ছেলে-বুড়ো এমনকি মেয়েরাও চলে এলো। আমাদের উৎসাহ আর ধরে না। এর মধ্যে রান্না শেষ হলো। আর দেরি করি না, গান ফেলে পাত পেতে বসে পড়ি।
রাতে টানা ঘুম দিয়ে খুব সকালে উঠি সবাই। যে ঝর্নাকে কেন্দ্র করে এ পাড়া গড়ে উঠেছে, সাকল সকাল সেটার খোঁজে বেরোই। ঝিরি ধরে এগোতে থাকি। এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে ঝিরি। মাঝেমধ্যে বড় বড় পাথর। মাঝে মাঝে বসতিও আছে। এদের মধ্যে চামকা থাকলেও বেশিরভাগ বসতি তঞ্চঙ্গা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাই চেংরাছড়ি ঝর্নায়। শীর্ণ জলধারা। এই পানিতে গোসল ভালমতো গোসল হবে না। ঝর্না ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে। এবার অনেক পানি পাই। গোসল করি অনেকক্ষণ ধরে। শীতল জল বড় ভালো লাগে।
ফিরে নুডলস এর সাথে মাঝিদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নৌকায় উঠি। খানিক যেতেই আবার বৃষ্টি নামে।
আমরা আবার মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি জলের নাচন। আমাদের মাঝি জাল দিয়ে ধরে বড় সাইজের কালিবাউস। আমরা ভাগ চাই, কিন্তু দেয় না। এটা তার ধরা মৌসুমের প্রথম মাছ, তাই সে একাই খাবে। বৃষ্টি থামে ফারুয়া বাজারে এসে। আমরা ট্রলারে গিয়ে উঠি। এবার ফেরার পালা।
কীভাবে যাবেন: আরামবাগ, ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, এস আলম,
সৌদিয়াসহ আরো কিছু বাস কাপ্তাই যায়। ভাড়া ৪০০ টাকা। ফারুয়া পর্যন্ত ট্রলার ভাড়া তিন দিন পাঁচ হাজার টাকা। ফারুয়া থেকে ইঞ্জিন নৌকা প্রতিটি দুই হাজার টাকা। কাপ্তাই থেকে খাবারের জিনিসপত্র প্রয়োজনমতো সঙ্গে নিতে পারেন। ফারুয়া বাজারেও অনেক কিছু পাবেন। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে যাওয়া ভালো।
No comments:
Post a Comment