Monday, July 30, 2012

ফারুয়া পাহাড়ে



chobi:homayed ishak moon.BTEF
শাহীন আহমেদ


এবার পাহাড়ে নাকি থইথই জোছনা দেখা যাবে। সেই জোছনায় ভেসে যাবে বন, গ্রাম, নদী, জনপদ। জোছনার নৃত্য দেখতে আমরা কোমর বেঁধে লেগে গেলাম। সেদিন ছিল বুদ্ধ পূর্ণিমা। পরের দু’দিনও ছুটি। জোছনা দেখতে এবার রাঙামাটির বিলাইছড়ির উজানে ফারুয়া ছেড়ে পানছড়ি পর্যন্ত যাব। ১৩ জনের দল। রাতে ঢাকা থেকে শ্যামলী বাসে রওনা দিয়ে কাপ্তাই পৌঁছালাম ভোরে। বাস কাউন্টার-লাগোয়া রেস্টুরেন্টে নাশতা খেয়ে নৌকা ঘাটে যাই। নৌকা সমিতির বুলবুল ভাইয়ের সহযোগিতায় একটি ভালো ট্রলার পাওয়া গেল। ট্রলারে ওঠার আগে দরকারী কেনাকাটা করে নেন জিলানী ভাই।কাপ্তাই লেকের কচুরীপানা আর বাঁশের চালি ঠেলে এগিয়ে চলে ট্রলার। নাসির মাঝি একাই একশ’। ট্রলার কাপ্তাই লেক ধরে কিছুটা এগিয়ে বাঁক নিয়ে ঢুতে গেল ছোট্ট একটি খালে। নাম রাইক্ষং। পাহাড় সারির মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে খাল। বৃষ্টিধোয়া পাহাড় আজ দারুণ সতেজ। সবাই ভিড় করলাম ট্রলারের ছাদে। দলে তবলা, করতালের সঙ্গে নতুন যোগ হয়েছে গিটার। গানের দল গলা ছেড়ে দিল। গাইড বঙ্কিম তঞ্চঙ্গ্যাকে ফোন করতেইতিনি বললেন, আসুন। আমি সকাল থেকেই আপনাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।বিলাইছড়ি বাজারে যখন নৌকা ভেড়ে তখন দুপুর। তেলাপিয়ার ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে ট্রলার ছোটাই আরো উজানে। সবুজ পাহাড় থেকে এখন ভ্যাবসা গরম আসছে। গরমের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে আমরা ট্রলারের ভেতরে ঢুকে পড়ি। অনেকেই ভাতঘুম দেয়। বিকেলের দিকে ঠা-া বাতাস ছাড়ে। বৃষ্টিও আসবে মনে হয়। ফারুয়া এখনও অনেক দূর। রাত হওয়ার আগেই পৌঁছানো দরকার। দ্রুত ট্রলার চালিয়েও খুব একটা সুবিধা হলো না। সন্ধ্যা নেমে এলো। তারপরও ট্রলার এগিয়ে যাচ্ছে। আরো কিছুদূর গিয়ে মাঝিকে বলি, Ñও ভাই, রাত যে হয়ে গেলো, ফারুয়া কই? মাঝি যা উত্তর দেয় তাতে ঠিক দিশা পাওয়া যায় না। এক জায়গায় এসে হঠাৎই থেমে যায় ট্রলার। খটকা লাগে। টর্চ হাতে অনেক মানুষ দেখতে পাই। বঙ্কিমদা বলেন, খালে বৃষ্টির পানিতে অনেক মাছ এসেছে। জাল দিয়ে মাছ ধরছে এরা। নারী-পুরুষ, ছেলে-মেয়ে সবাই মেতেছে মাছ ধরার উৎসবে। বেশ লাগল।


ইতোমধ্যে আকাশে রুপালি চাঁদ উঠেছে। সাদা মেঘের দল সেই চাদের সাথে লুকোচুরি খেলছে। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার আমাদের চলা শুরু হলো। বেশ রাত করে আমরা পৌঁছাই ফারুয়া বাজারে। বাজারে খাবার বলতে পাওয়া গেল ঠা-া ভাত, আলুভর্তা আর ডাল। চাইলে ডিম ভাজা পাওয়া যাবে। দোকানী জানালেন, মাছ আছে। তবে রান্না হতে অনেক সময় লাগবে। শেষমেষ ডোবা তেলে মাছ ভেজে পেঁয়াজ দিয়ে রান্না আর ভাত বসানোর সিদ্ধান্ত হলো।দোকানী লেগে যান রান্নার কাজে। আর আমরা জমে যাই গল্পে। চিনি কম দুধচা আর খাজা (গজা) খেয়ে একপাক চক্কর দিতে বের হই ‘এল’ সাইজের ফারুয়া বাজারটা। ভরা জোসনায় বাজারের আশপাশের পাহাড় সব পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। বাজারে একটি হিন্দু মন্দিরও আছে। ফারুয়া বাজার ঘুরে ফিরে এসে পেটপুরে মাছভাত খাই। ভরা পেটের আমেজে আবারো খেয়াল করি আকাশ ভেঙেজোছনা নেমেছে। দোকানপাট, গাছপালা, খালের জল, কাপড়চোপসব জোছনা ধোয়া সাদা। চারদিক অন্ধকার থাকয় জোসনা আরো তিব্র হয়েছে, যা বর্ণনার সাধ্য আমার নেই। সাবই গোল হয়ে বসি ট্রলারের ছাদে। জোছনার আলোয় চলতে থাকে গান।খুব ভেরে ঘুম ভাঙে। হাতে তেমন কাজ নেই। বাজারে যাই, ঘোরাঘুরি করি, নাশতা খাই। এতক্ষণে আকাশে যে মেঘদল


উড়োউড়ি করছিল তা এখন বৃষ্টি হয়ে নেমে এসেছে ফারুয়া বাজারে। টানা চার ঘণ্টা চলে বৃষ্টি হলো। হঠাৎ খেয়াল করি পাহাড়ি ঢল নামেছে খালে। অল্প সময়েই খাল ভরে গেল। খালে প্রচ- স্রোত। বৃষ্টি কিছুটা ধরে এলে আমরা খালের ওপারে যাই। এখানে বঙ্কিমদার বাড়ি ও দোকান। জায়গাটি খুব সুন্দর! পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর, অনেক খোলা জায়গা। ওপরে বৌদ্ধ মন্দির। দারুণ পরিবেশ।


বেলা বাড়তে থাকে। ফেরার সময় হয়ে আসে। পাহাড়ি ঢল নেমে গেলে পাশের খালের পানি শুকিয়ে যাবে তাই ট্রলার রেখে ছোট দু’টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে ফারুয়া বাজার ছেড়ে রওনা হই। এই বাজারের পরে আর কোনো বাঙালি বসতি নেই। আমরা পানি উজিয়ে আস্তে আস্তে চলি।


এভাবে একসময় গোবাছড়ি, চেংড়াছড়ি হয়ে চলে যাই পানছড়ি। তখন বিকেল নেমেছে। ঝর্নায় গোসল করি দলবেঁধে। তারপর একটা দোকানে গাছপাকা পাহাড়ি মিষ্টি কলা, বেলা বিস্কুট ও চা খাই। অন্ধকার নামার আগেই ফিরে আসি চেংড়াছড়ি পাড়ায়। কারবারির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। এর মধ্যে বড় দু’টি মোরগ নিয়ে আসে একজন। ২০০ টাকা কেজি দরে একটি কিনে নেই আমরা। নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া রাইক্ষং খালের উপর কারবারী আমাদের জন্য একটি ঘর বরাদ্দ করেন। ঘরের লোকজন গেছে জুম চাষে। তার মানে এই রাতে আমরাই ঘরের মালিক। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। আমাদের চিফ শেফ হোমায়েদ ইসহাক মুন মোরগ নিয়ে রান্না করতে যায়। ওয়াকিল ভাই গিটার বাজিয়ে গান ধরেন। গলা মেলান সামির ভাইÑ সখি কুঞ্জ সাজাওগো আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’। আমাদের গান শুনতে পাড়ার ছেলে-বুড়ো এমনকি মেয়েরাও চলে এলো। আমাদের উৎসাহ আর ধরে না। এর মধ্যে রান্না শেষ হলো। আর দেরি করি না, গান ফেলে পাত পেতে বসে পড়ি।


রাতে টানা ঘুম দিয়ে খুব সকালে উঠি সবাই। যে ঝর্নাকে কেন্দ্র করে এ পাড়া গড়ে  উঠেছে, সাকল সকাল সেটার খোঁজে বেরোই। ঝিরি ধরে এগোতে থাকি। এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে ঝিরি। মাঝেমধ্যে বড় বড় পাথর। মাঝে মাঝে বসতিও আছে। এদের মধ্যে চামকা থাকলেও বেশিরভাগ বসতি তঞ্চঙ্গা। হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে যাই চেংরাছড়ি  ঝর্নায়। শীর্ণ জলধারা। এই পানিতে গোসল ভালমতো গোসল হবে না। ঝর্না ছাড়িয়ে এগিয়ে যাই পাথুরে দেয়াল ঘেঁষে। এবার অনেক পানি পাই। গোসল করি অনেকক্ষণ ধরে। শীতল জল বড় ভালো লাগে।


ফিরে নুডলস এর সাথে মাঝিদের তাড়া খেয়ে তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছিয়ে নৌকায় উঠি। খানিক যেতেই আবার বৃষ্টি নামে।


আমরা আবার মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকি জলের নাচন। আমাদের মাঝি জাল দিয়ে ধরে বড় সাইজের কালিবাউস। আমরা ভাগ চাই, কিন্তু দেয় না। এটা তার ধরা মৌসুমের প্রথম মাছ, তাই সে একাই খাবে। বৃষ্টি থামে ফারুয়া বাজারে এসে। আমরা ট্রলারে গিয়ে উঠি। এবার ফেরার পালা।


কীভাবে যাবেন: আরামবাগ, ফকিরাপুল থেকে শ্যামলী, এস আলম,


সৌদিয়াসহ আরো কিছু বাস কাপ্তাই যায়। ভাড়া ৪০০ টাকা। ফারুয়া পর্যন্ত ট্রলার ভাড়া তিন দিন পাঁচ হাজার টাকা। ফারুয়া থেকে ইঞ্জিন নৌকা প্রতিটি দুই হাজার টাকা। কাপ্তাই থেকে খাবারের জিনিসপত্র প্রয়োজনমতো সঙ্গে নিতে পারেন। ফারুয়া বাজারেও অনেক কিছু পাবেন। প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে যাওয়া ভালো।

“উড়ন্ত পাখির গায়ে গুলি বসিয়ে দিতাম”- সাক্ষাৎকার



শাহীন আহমেদ
শিকার যে শুধু বন্যপ্রাণী হত্যা করা তা কিন্তু সকল অর্থে ঠিক নয়। একসময় দেশের বিভিন্ন জনপদে অনেক বন্যপ্রাণী ছিল। এসব প্রাণী মানুষের ক্ষতি করত। আবার মানুষের মধ্যে কেউ কেউ সাহস দেখানোর জন্যে তাদের শিকার করত। সালেহীন রেজা এই সাহসী দলেরই একজন। পুরনো ঢাকার লালবাগের মানুষ। বাবা শিকারী ছিলেন। দাদাও ছিলেন তাই। রক্তের ধারাবাহিক সম্পর্কের কারণে তিনিও হাতে তুলে নেন বন্দুক, পর্যায়ক্রমে হয়ে ওঠেন সাহসী শিকারী। তিনি তার শিকার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত কিছু মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন পচাব্দী গাজী, আকতারুজ্জামান কামাল (বাঘমামা), ওয়াহিদ উদ্দিন এবং রফিক। সালেহীন রেজা শিকার ছেড়েছেন প্রায় দুই দশক। কিন্তু দেশেরপথের সঙ্গে আলাপচারিতায়
 সে সময়ের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন - শাহীন আহমেদ।
দেশেরপথে: শিকারের আগ্রহ কীভাবে আপনার মধ্যে তৈরি হলো?
সালেহীন রেজা : আমার বাবা  ছিলেন শিকারী। দাদাও তাই। ছোট বেলায় বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে পাখি শিকারে যেতেন। বিশেষ করে মিরপুরের বর্তমান ইনডোর স্টেডিয়াম যেখানে, সেখানে আমাদের বাগান বাড়ি ছিল। অনেক পাখি ছিল। বাবার শিকার করা পাখি আমরা শৈশবে খেতাম। বলতে পারেন বাবার কাছ থেকেই শিকারের আগ্রহ আমার মধ্যে জন্ম নেয়।
দেশেরপথে: শুরু কীভাবে?
সালেহীন রেজা: আমি পুরনো ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা। ওখানকার কয়েকটি আদি পরিবারের একটি আমাদের পরিবার। বাড়ির পাশেই লালবাগের উন্মুক্ত কেল্লা। তখনও কেল্লায় সবদিকে দেয়াল ছিল না। কেল্লাায় ঘুরে বেড়াতাম। শৈশবে খুব দুরন্ত ছিলাম। ইট-পাটকেল দিয়ে পাখি, কবুতর মেরে ফেলতাম। কোনো গাছে পাখি বা কবুতর না পেলে শুধুই ঢিল ছুড়তাম। তবে যে কাজটা নিয়মিত করতাম তা হলো কেল্লায় একটি পুকুর ছিল, সেই পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতাম। সাঁতার বলতে পানিতে শুধু ঝাপাঝাপি করা। পুকুরে প্রচুর ঢোরা সাপ ছিল। নিয়মিত সাপ মারতাম। বলতে পারেন এই সাপ মারা আমার শৈশবের সাহসী শিকার। তবে মনে পড়ে ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি তখন একদিন সকালে বড় ভাইয়ের দু’নলা বেলজিয়াম বন্দুক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। সোজা মিরপুরে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে পাখি শিকার করি। প্রথম পাখিটা শিকার করার পর ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। মনে মনে খুব খুশি হই। মন বলে ওঠে, বাহ আমি তো শিকারী। সেদিন অনেকগুলো স্নাইপ- বোগতি পাখি শিকার করি। বাড়ি ফিরে আসি মহা আনন্দে। মনে মনে ভাবতে থাকি বাড়ি গেলে মা, বড়ভাই খুব খুশি হবেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর দেখি উল্টো চিত্র। তারা আমার উপর অনেক বিরক্ত। মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে শিকারের নেশা আমার আরো বেড়ে যায়।
দেশেরপথে: তারপর?
সালেহীন রেজা: তারপর পর্যায়ক্রমে শিকার করতে যাই সাভার, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ভোলা, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ এসব স্থানে। নরসিংদীর নিরমিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজলা, বিরুইল্লা, বটগর, নবীনগর, সোনারগাঁর নুনের টেক ও দাউদকান্দির হারামজাদার চরে অনেক পাখি শিকার করেছি। তবে এ শিকার করতে গিয়ে অনেক কষ্টের মুখোমুখি হয়েছি। শীতে, বৃষ্টির রাতে খোলা নৌকায় শুয়েছি। শীতের সকালে ধানী জমির আলে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাছের উপর রাত কাটিয়েছি। যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা যখন মনে পড়ে তখন নিজেরই কেমন যেন লাগে। আমার শিকারে সঙ্গী হিসেবে পেতাম শিকারী ওয়াহিদ উদ্দিন, শিকারী রফিক ভাইকে। রফিক ভাই ছিলেন বড় শিকারী। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে পরে একটি ব্রুনো-২ বন্দুক উপহার দিয়েছিলেন। তার বাড়ি ঢাকার মাতুয়াইলে। উনাদের বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতে যেতাম। রফিক ভাই খুব সাহসী ও চালাক শিকারী ছিলেন। ঢাকা-সাভার রোডে ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে সাভারের নয়ারহাট গজারীবনে আমরা প্রচুর খরগোশ (ফইট্টা) শিকার করেছি। খরগোশ শিকারের বিষয়টা ছিল বেশ মজার। জিপ গাড়ির লাইট বনের একদিকে রাখলে খরগোশগুলো লাইট দেখতে বের হতোÑ তখন আমরা শিকার করতাম। এখানে একটু বলি, রফিক ভাই হলেন বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বড় ভাই। আবার হাওরের গল্প শুনাই। হাওরে এতো মাছ ছিল যে, প্রায় সময় মাছ লাফিয়ে নৌকায় উঠে যেতো। মাছে ভাতে বাঙালি যে কথা প্রচলিত আছে তা তখন দেখেছি। পানিও ছিল অনেক। শতকে শতক, হাজারে হাজার। আমার শিকার জীবনে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মিরপুরের উসমান আলী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উজির আলী মাঝির কথা। এরা ছিলেন আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। একদিনের ঘটনা বলিÑ মিরপুরে পাখি শিকার করতে গেছি। হঠাৎ একটি সাপ দেখি পানি দিয়ে যাচ্ছে। আমি লালবাগের কেল্লার পুকুরে ঢোড়া সাপের মতো মনে করে খপ করে ধরে ফেলি। পরে মাঝে চিনে ফেলে এটি ছিল বিষাক্ত কালকেউটে। তখন উসমান মাঝি বলে,
সাবধান; সাপ ছাড়বেন না।
পরে আমরা সাপটাকে মেরে ফেলি। মাঝি ভয়ংকর ভয় পায়।
আরেকদিনের গল্প শোনাই, মিরপুর এলাকায় গেছি, মনের আনন্দে পাখি শিকার করছি। হঠাৎ দেখি বালির মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি। প্রায় বুক পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। পরে উসমান মাঝি বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে আমার গায়ের লোম এখনও দাঁড়িয়ে যায়।
আরেকটা গল্প বলি, আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু একদিন রাতে পাখি শিকার করছি, একটি পাখির উপর গুলি করলাম। কিন্তু পাখির গায়ে লাগলো না। আরো বারকয়েক গুলি চালালাম, কিন্তু না, এবারও গুলি লাগল না। আমার সঙ্গীরা প্রচ- ভয় পেয়ে যান। তাদের ধারণা এটি ভূত হবে। কিন্তু কেন পাখির গায়ে গুলি লাগলো না সে রহস্য আজো জানা গেল না। এমন তো নয় যে, আমার হাতের দিশা ঠিক নেই। আমি কিন্তু তখন উড়ন্ত পাখির গায়ে গুলি বসিয়ে দিতাম।
দেশেরপথে: সুন্দরবন ভ্রমণ নিয়ে কিছু বলুন?
সালেহীন রেজা: সুন্দরবন ভ্রমণের আগে শিকারী পচাব্দী গাজীর গল্প শুরুতে কিছুতে কিছুটা করে নেয়া দরকার। ১৯৮৫ সালের দিকে ইসলামপুরের বিখ্যাত বন্দুকের দোকান শিকার ও শিকারীর মালিক ডাঃ নাসির সাহেবের দোকানে আড্ডা দিতাম। সেখানেই পরিচয় বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজীর সঙ্গে। তখন সুন্দরবনের আরেক শিকারী আকতারুজ্জামান কামাল ও ছিলেন। পচাব্দী গাজীর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী এলাকায়। তিনি ঢাকায় এলে সব শিকারী ডাঃ নাসির সাহেবের দোকানে আড্ডায় যোগ দিতেন। তখন সবার মধ্যে একটা আনন্দভাব থাকতো। এভাবে আড্ডার মাধ্যমে গাজী সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেড়ে যায়। সে সম্পর্ক আমি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখি। গাজী সাহেব পরে ঢাকায় এলে আমার বাসা বা আমার নিজের হোটেলে তাকে যতœ করে রাখতাম। যতœ করতাম এ কারণে যে, তিনি নিজে প্রায় ৫০টির অধিক বাঘ শিকার করেছেন। ১৯৮৬ সালে আমার সম্বন্ধি ইসলাম উদ্দিনসহ আমরা গাজী সাহেবের সঙ্গে সুন্দরবনে যাই। জীবনের প্রথম সফর। অনেক স্বপ্ন ছিল এই বনে আসবো। অনেকে এটাকে বনের রাজাও বলেন। এখানে এলে বাঘের দেখাও মিলতে পারে। আর সঙ্গী আছেন বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজী। এখানে একটু বলতে চাইÑ ওই সময় ঢাকায় শুটিংক্লাবের উদ্যোগে শুটিং কমপিটিশন হবে। আমাকে তার বিচারক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এখানে যুক্ত হওয়া ছিল অনেক প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। কিন্তু প্রোগরামের সঙ্গে যুক্ত হইনি। কারণ, গাজী সাহেবের সুন্দরবনে যাবো। আমি গুরুত্ব দিয়েছি সুন্দরবন যাওয়াকে। এবার আসি মূল গল্পেÑ যখন বুড়িগোয়ালিনী পৌঁছলাম তখনই মন ভরে গেলো সেখানকার দৃশ্য দেখে। বুড়িগোয়ালিনীর ফরেস্ট স্টেশনের চারপাশে তখন ছিল গভীর বন। হাতে চালিত ছইঅলা নৌকায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমার মধ্যে খুশি খুশি ভাব। কতো গল্প শুনেছি এই বনের। বাঘ, হরিণ, সাপ কতো বন্য প্রাণী আছে এখানে। আস্তে আস্তে সব কিছু দেখবো। বনে চলার সব নির্দেশনা দিচ্ছেন গাজী সাহেব। পানিতে হাত বা পা রাখবো না কারণ করাত মাছে কেটে ফেলতে পারে। এই মাছ আঘাত করলে রক্ত বন্ধ হয় না। কাজেই সাবধান। সবসময় চোখ খোলা রাখতে হবে। কারণ যে কোনো সময় বাঘের সঙ্গে দেখা হতে পারে। দলবেঁধে থাকতে হবে। কারণ বাঘ দলবদ্ধ মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। বনে নেমে পা সাবধানে রাখতে হবে। যেকোনো সময় পা কেটে যেতে পারে। ঘাসপথে সাবধানে চলতে হবে কারণ ঘাসের মধ্যে অজগর লুকিয়ে থাকে। প্রথমবার সুন্দরবন যাবার মোহমুগ্ধতা এখনও আমার চোখে লেগে আছে। তখন সুন্দরবনে দেখেছি প্রচুর গাছপালা, নদীতে কতোজাতের মাছ। প্রায় সাত কেজি ওজনের কাইন মাছ দেখেছি। হরিণ, বাঘ ছিল অনেক। তখন বনে ট্যুরিস্টরাও যেতেন না বললেই চলে। মৌয়াল, বাওয়ালী ও জেলেরা যারা পারিবারিকভাবে স্থায়ী, তারাই শুধু বনে থাকতো। বাইরের কেউ যেত না। কারণ অন্যদের ভয় ছিল যে, বনে যারা যাবে তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সুন্দরবন নিয়ে হাসির একটা বিষয় বলিÑ আমার ধারণা ছিল গোলপাতা গোল হয়। কিন্তু বাস্তবে ছিল তার উল্টো।
সুন্দরবনে এরপর অনেকবার গেছি। টুকটাক শিকার করেছি। প্রতিবার সঙ্গে পেয়েছি শিকারী পচাব্দী গাজী ও আকতারুজ্জামান কামালকে। দু’জনের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমি পেয়েছি। এ দু’জনের কাছ থেকে দিখেছি সুন্দরবনকে কীভাবে ভালবাসতে হয়। যারাই বন নিয়ে কোনো কাজ করতে চেয়েছেন বা বনে যেতে চেয়েছেন তারা সাহায্য পেয়েছেন পচাব্দী গাজীর কাছ থেকে। পচাব্দী গাজী ছিলেন অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের মানুষ। প্রথম তাকে দেখে আমি খুব অবাক হই। কারণ আমি মনে করেছিলাম তিনি উঁচু, বিশালদেহী হবেন। বাস্তবে দেখলাম ছোটখাটো একজন মানুষ। চরম অভাবে তার দিন গেছে, কিন্তু কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি।
দেশেরপথে: পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছু বলুন?
সালেহীন রেজা: আমিতো শিকারের পেছনে লেগেই থাকতাম। বাড়িতে মন বসতো না। আমার মা পরে আমাকে গৃহী করার জন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। রূপবতী স্ত্রী। তারপরও আমি ঘরে মিথ্যে বলে যেতাম। বউ প্রথম প্রথম অভিমান করতো। পরে বিরক্ত হতো। আমার প্রথম সন্তানের জন্মের পর ধীরে ধীরে শিকারের নেশা কিছু কমে যায়। পরিবারের দিকে বেশি মনোযোগী হই। তারপর থেকে আর শিকারের পথে পা বাড়াইনি। তবে শিকার বা বেড়াবার টান এখনও মন থেকে মুছে যায়নি। টেলিভিশনে এখনও বন্যপ্রাণী বা ভ্রমণের ডকুমেন্টরিই বেশি দেখি।

Saturday, July 28, 2012

মুলাগুল চা বাগান



শাহীন আহমেদ
 এক শীতের সকালে আমরা ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাইসেখান থেকে জকিগঞ্জের বাসে শাহবাগ নামিতারপর টেম্পোতে সোজা কানাইঘাট বাজারসামনেই সুরূপা সুরমা নদীতার রূপ দেখে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলদিনটি ছিল হাটবারনৌকায় সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা এসেছেনদী পাড়ে তাই নৌকার সমাবেশসুরমা নদীর পলিসমৃদ্ধ কানাইঘাট রবিশস্যের জন্য বিখ্যাতশাকসবজি, তাজামাছ, মনোহারী আরও সব পসরায় বাজার জমজমাটআমরা কচি শসা কিনিমজা করে খাইতারপর সঙ্গী সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে নিয়ে মুলাগুল যাওয়ার জন্য ঘাটে যাইহোঁচট খাই শুরুতেইমুলাগুলের দিকে আজ আর কোনো যাত্রীবাহী নৌকা যাবে নাঅনেক বলে কয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমরা একটা নৌকা ভাড়া নিইমাঝির কাজ আমাদের শুধু পৌঁছে দেয়াফিরতে হবে নিজেদের মতো
সরু বার্কির চেয়ে একটু বড় নৌকাদুজন মাঝিআমাদের যাত্রা শুরু হয়চলছি তো চলছিকোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গোঁড়ালিলগি-বৈঠায় ভর দিয়ে নৌকা এগিয়ে যায় সামনের দিকেনদীর দুই তীরে আদিগন্ত ফসলের মাঠনাইতে নামা নারী-পুরুষে, বৌ-ঝিদের কলসিতে জল ভরায় আর শিশুদের দূরন্ত উল্লাসে মেতেছে সুরমা
অল্প পানির কারণে মাঝে মাঝে আমরা নেমে পড়িমাঝিদের সঙ্গে ধাক্কায় শরীক হয়ে নৌকা সামনের দিকে নিয়ে যাইএভাবে একসময় সুরমা নদী ডানে রেখে লোভাছড়া নদীতে গিয়ে পড়ে নৌকাএ নদীতে জলের ছড়াছড়ি, স্রোতস্বিনী  সুরমা নদী ছুটে চলে লোভাছড়ার পানিতেএখান থেকে আর কিছু দূর এগোলেই সুরমার জন্মস্থানআসাম থেকে আসা বরাক নদী দুভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরেলোভাছড়া খাড়া পাহাড়ি নদীউল্টোস্রোত ঠেলে এগোতে থাকে আমাদের নৌকা
মুলাগুলায় যখন নামি তখন সূর্য মাথার ওপরভাড়া মিটিয়ে খানিক এগোতেই বাজারখবার হোটেলে গিয়ে দেশি মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত খাই পেট ভরেচা-পানের পর কাঁচা সুপারি ও ইন্ডিয়ান বত্রিশ জর্দা দিয়ে খাসিয়া পান চিবোতে চিবোতে বাজারের অন্যদিকে হেঁটে গিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চা বাগানের দিকে এগোতে থাকিএক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াইআকাশ ছোঁয়া খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় আমাদের পথ আটকে দাঁড়ায়একপাশে নদী আরেকপাশে পাহাড়মাঝখানে সবুজ ঘাস বিছানো এক চিলতে জায়গাআমরা বসে পড়িগড়াগড়ি যাইঅনাবিল, অদেখা, অপূর্ব এক পৃথিবী আমাদের মনে জড়িয়ে থাকে, চোখ ভরিয়ে রাখেভারত এখান থেকে দশ মিনিটের পথআমরা পা বাড়াইপথে পাই বিডিআর ক্যাম্পতারপরই গাঢ় সবুজমাখা মায়াময় চা বাগান
একসময় এ চা বাগানের পথ সোজা চলে গিয়েছিল পাহাড় পেরিয়ে আসামেএকটি পুরানো কালভার্ট এখনও তার সাক্ষী হয়ে আছেপ্রথম দেখাতেই চা বাগানটিকে আলাদা মনে হয়ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু বয়স্ক গাছএলাকাটি খুবই নির্জনপথ ধরে হাঁটতেই বামে সুন্দর ডাকবাংলোডানে ঝাঁকড়াচুলের বিশাল শতায়ু বটবৃক্ষ
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছেচা শ্রমিকরা ফিরতে শুরু করেছে ঘরেচারদিকে ঘন অন্ধকার ক্রমশ জমাট বাঁধছেচা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠেছে কেরোসিনের আলোআরেকটু সামনে এগোতেই চোখে  পড়ে চা শ্রমিকদের গানের তালে তালে নাচআমরা দাঁড়িয়ে যাইভাষা বুঝতে অসুবিধা হলেও তাল ধরতে পারিএখনও কানে বাজেÑ “আবেন ডোনা ঝুরি ঝুরি...অন্ধকারের মধ্যে একদল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে মনের আনন্দে গান গাইছে... নাচছে.. কেমন ছবির মতো! শ্রমিকরা এইসময়ে আমাদের দেখে বিস্মিত হয়আমরা কোথায় থাকব জানতে চায়আমরা আজই ফিরে যাওয়ার কথা বলি
আমাদের সঙ্গে তারাও আমাদের ফেরা নিয়ে ভাবতে থাকেকারণ চা বাগানের এ রাস্তা দিয়ে যাত্রিবাহী গাড়ি চলে নাএ সময় যাওয়ার জন্য সাধারণত কোনো যানবাহন পাওয়া যায় নাভেবেচিন্তে তারা বলে, ঘাবড়াবেন না, পাথর কোয়ারির শেষ ট্রাক এখনও যায়নিভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যাবেননা পেলে আমরা তো আছি, আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেনতাদের দরদ দেখে ভালো লাগেটেনশান ঝেড়ে ফেলে আমরাও তাদের নাচতে থাকি
হঠাৎ করেই দূরে বিড়ালের চোখের মতো লাইট জ্বালিয়ে কিছু একটা আসতে দেখা যায়আমরা বুঝতে পারি এটাই সেই পাথরবাহী ট্রাকচা শ্রমিকরা আমাদের গাড়িতে তুলে দেনরাতের অন্ধকারে চলতে চলতে গাড়ির আলোতে বড় বড় গাছওলা চা বাগানটি ফিরে ফিরে দেখিপথটি ছিল গা ছমছম করা রোমাঞ্চকরচারদিকে কোনো মনুষ্য বসতি নেইশুধুই টিলা আর বন-জঙ্গলএকসময় রাস্তা ছেড়ে ধানি জমির মাঝখান দিয়ে ট্রাক ছোটেআমরা পৌঁছে যাই কানাইঘাট বাজারে


রামাদং

chobi.mahi uddi.BTEF

chobi.moon.BTEF
শাহীন আহমেদ
পাহাড়ের পর পাহাড়। আবার পাহাড়। আমরা দল বেঁধে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে ঘামি। ঘেমে নেয়ে উঠে একাকার। তেতো হয়ে ওঠা সূর্য মাথার উপর যেন লেপ্টে আছে। গরমে শরীর জ্বলতে থাকে। তারপরও আমরা হাঁটি। রামাদং যেতেই হবে। পার্বত্য বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি উপজেলার সীমান্তবর্তী পাহাড় রামাদং। এখানে পৌঁছতে এখনও প্রায় দিনের অর্ধেক সময় লেগে যাবে। হাঁটতে হাঁটতে মিষ্টি বাতাস পেয়ে একটু জিরিয়ে নিই। জলযোগ করি। ফের হাঁটা শুরু করি। দ্রুত। সন্ধ্যার আগেই পৌঁছতে হবে। চারদিকে অবাক করা দৃশ্য! কোনো পাহাড় আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটি আবার কাত হয়ে আরামে ঘুমোচ্ছে। তাকিয়ে দেখেছি ছোট-বড় হাজার ধরনের গাছ। বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, বিশাল পাথর, বুনো রামকলার ঝোপ। আর দেখেছি কতো জাতের ফুল! পাহাড়ি ঝিরিতে দেখেছি শান্ত-øিগ্ধ জল।
আমরা ঢাকার ফকিরাপুল থেকে এস. আলমে চেপে বসি। অসংখ্য বাসের কাটাকুটি খেলা এবং আকাশের নক্ষত্র গুনতে গুনতে ভোরবেলা পৌঁছে যাই বান্দরবান। চমৎকার একটি শহর! চারদিক আকাশ ছোঁয়া সব পাহাড়। মাঝখানে শহর। সকালের নাস্তা সেরে রোয়াংছড়ি যাবার জন্যে চাঁন্দের গাড়িতে উঠে বসি। গাড়ি একটু সামনে যেতেই একদল পুলিশ আমাদের গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো। তাদের বক্তব্য, রোয়াংছড়ি মেলার জন্য এ গাড়ি রিক্যুইজিশন করা আছে। আমাদের তর্কের তুফানেও তারা হাল ছাড়েন না। পরে একটা ট্রাকে তুলে দেন। আমরা নিরুপায়। রাগে, ক্ষোভে, দুঃখে ট্রাকে উঠে দাঁড়াই। কিন্তু গাড়ি চলার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কলজে, নাড়িভুঁড়ি সব নড়তে লাগলো। ঝাঁকির পর ঝাঁকি। ঝাঁকি খেতে খেতে ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে যাই রোয়াংছড়ি স্কুলে। পায়ে হেঁটে বাজারে যাই।
প্রবীরদা চলে আসেন। আমাদের মাঠে নিয়ে যান। মাঠে দু’দিন ধরে চলছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠান। পুরো বান্দরবান জেলার এমনকি বিদেশ থেকে এসেছেন অনেকে। অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে মেলা বসেছে। জেলার বয়োজ্যেষ্ঠ বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ উসারা মহাস্তবির আশি বছর বয়সে মারা গেছেন। তাঁর শেষকৃত্য সসম্মানেই এ আয়োজন।
সন্ধ্যায় শুরু হয় বাজি পোড়ানো। বেশক’টি ছোট ছোট মন্দির। বড় একটি মন্দিরে শায়িত আছেন প্রয়াত উসারা। এ মন্দিরকে স্বর্গের সঙ্গে তুলনা করা হয়। তারের মাধ্যমে বেশ দূর থেকে বাতি  জ্বালিয়ে দিলে ক্ষীপ্র গতিতে গিয়ে পড়ে মন্দিরে। এভাবেই তাঁকে দাহ করা হয়। এটাই নিয়ম। পুণ্যার্থীরা ইহকালীন কল্যাণ ও পুনর্জন্ম যাতে মঙ্গলময় হয়, এজন্যে বাজি মানত করেন। প্রতিটি বাজি একশ’ পঞ্চাশ টাকা। মন্দিরের নির্ধারিত ভিক্ষুদের কাছ থেকে কিনে নিতে হয় এ বাজি। একে একে বাজি পোড়াতে থাকলে এক সময় মন্দিরে আগুন ধরে যায়। তারপর আগুনের লেলিহান শিখা আকাশের দিকে ধাবিত হয়। সমবেত মানুষের প্রার্থনা ও কান্নার দৃশ্য বড়ই হৃদয়গ্রাহী! এভাবেই মহামতি উসারার শেষকৃত্য সমাপ্তি হয়ে যায়।
রাতে মোরগ জবাই করে খাবারের আয়োজন করা হয়। মশলা ও ঝাল বেশি। ইতোমধ্যে পরিচয় হয় স্থানীয় শিশির তংচঙ্গ্যা ও বিশ্বনাথ তংচঙ্গ্যার সাথে। শিশিরদা চমৎকার হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষ। রাতে তাদের ক্লাবে ঘুমাই। তিনি সবার জন্যে চাদরের ব্যবস্থা করে দিলেন। বাঁশের তৈরি ক্লাব ঘরটি খুবই সুন্দর। পরিপাটি ও দৃষ্টিনন্দিত। ভোরে আমরা উঠবার আগেই শিশিরদা তার দলবল নিয়ে হাজির।
সকালের নাস্তা শেষ করেই আবার যাত্রা শুরু করি। গন্তব্য রামাদং। প্রথমেই পাই বাঘছড়ি ঝিরি। ঝিরির জলে শব্দ করে হাঁটতে থাকি। মাইল তিনেক এভাবেই হাঁটি। পরে শুরু হয় তুলাতুলি পাহাড়। রিজার্ভ ফরেস্ট। প্রথম পাহাড়ে উঠতে অনেকেই হাঁপিয়ে ওঠে। একটু জিরিয়ে নেয়াতে ক্লান্তি দূর হলো।
আবার যাত্রা শুরু। ঘণ্টাখানেক হাঁটার পর আবার ক্লান্তি। রালখাং পাড়ায় জল পান করি। ফের হাঁটা। ঘণ্টাদুয়েক পর আসি পাইখ্যাং পাড়ায়। এটি বমদের পাড়া। বেশ গোছানো এবং পরিচ্ছন্ন। সামনের দিকে চলতে থাকি। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। রামাদং জয়ের নেশায় দ্রুত পা চালাই। এক সময় বড় বেশি ক্লান্ত অনুভব করি। গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেই। পিপাসা লেগেছে খুব। কিন্তু কারো কাছে পানি নেই। আগন্তুক এক খুমী পরিবারের কাছে পানি চেয়ে পান করি।
আমরা চলতে থাকি। আরো কিছুদূর যেতে আশ্চর্য হয়ে দেখি, আকাশের দিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে রামাদং পাহাড়। বিকেলের কোলে মাথা রেখেছে। আস্তে আস্তে নেমে আসছে সন্ধ্য। দেখতে রামাদং খুব কাছে লাগে। কিন্তু এর নিচে পৌঁছতে এখনও ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। এবার নিচে নামতে শুরু করলাম। খাঁড়া পাহাড়। খুব সাবধানে নামতে হচ্ছে! ঘণ্টাখানেক পর পৌঁছে যাই রনিনপাড়ায়। রামাদংয়ের নিচে মানুষের শেষ বসতি। এ পাড়ায় তংচঙ্গ্যা ও বমদের বসবাস। আমরা তংচঙ্গ্যা জয়ধর মেম্বরের বাড়িতে উঠি।
খাবারের আয়োজন চলছে। দুপুরে ভাত খাওয়া হয়নি। ক্ষুধায় বড় অস্থির লাগে। খাবার আসতেই খেয়ে দেয়ে ঘুম।
সকালে যে যার মতো ঘুরছে। ছবি তুলছে। কেউ আবার ঘুমোচ্ছে। রামাদং সকালের সূর্যের আলোয় হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। বড় সুন্দর, হৃদয়গ্রাহী দৃশ্য!  এখন ফিরে যাবার পালা।
সকালে খিচুড়ি খেয়ে রওয়ানা দিই। লাইন ধরে হাঁটি। বাঁশ আর বাঁশ। পরে মনরেম পাড়ায় বিশ্রাম নেই। কিছু খেয়ে নিয়ে আবার শুরু করি হাঁটা। আমরা সবাই ক্লান্ত। খাড়া এক একটা পাহাড়ের নিচে থেকে উপরে উঠতে উঠতে ভাবি, এটি পাড়ি দেবো কীভাবে?
এইভাবে মাইল খানেক হাঁটি। একসময় বড় আরাম লাগে। ঝিরির এক জায়গায় এসে দেখি, বিশাল বিশাল আকারের পাথর। এত বড় পাথর আগে কখনো দেখিনি। তারপর আবার হাঁটা। এবার একটি পাহাড়ি ছড়া পেয়ে যাই। শীতল জল। প্রাণভরে øান করে নিই। তারপর আবার হাঁটা। এক সময় নাগাল পেয়ে যাই রেংছড়ি বাজার। গাড়ি রিজার্ভ করে আসি বান্দরবান। এস. আলম-এ চেপে সোজা ঢাকা।

Friday, July 27, 2012

সিলেটের শীতল পাটি



শাহীন আহমেদ
সিলেটের শীতল পাটি শীতল করে মন। গরমকালে সিলেটের প্রায় সব বাড়িতেই বিছানার চাদরের ওপর এই পাটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে আরাম জুরোতে এই পার্টির ওপরই ভরসা করেন তারা। এর কদর আছে সিলেট থেকে সুদূর বিলেত পর্যন্ত। পার্টি শিল্পিরা ঘুঘু ডাকা অলস দুপুরে বা বর্ষণ মুখর দিনে অথবা আকাশ ভাঙ্গা জোছনা রাতকেই বেছে নিয়ে পাটি বুনতে। এসময় ধোঁয়া ওঠা এক পেয়ালা রঙ চা’য়ের সাথে শুকনো মুড়ি আর সুখ দুঃখের গল্প হয় তাদের সঙ্গী।
মুর্তা নামক এক প্রকার সরু গাছের ছাল দিয়ে তৈরি করা হয় এই পার্টি। মুর্তা গাছ ধারালো দা বা বটি দিয়ে ৪/৫ টুকরো করে কেটে ছাল বা বেত বের করে নেওয়া হয়। এরপর বেতগুলো এক ঘন্টা পানিভর্তি টিনেরপাত্রে ভিজিয়ে, গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ শেষে বেতগুলো রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠা-া পরিষ্কার পানিতে ৫/১০ মিনিট ভিজিয়ে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসাবে ব্যবহার যোগ্য হয়। অনেকসময় পাটিতে নানা রঙ ও চিত্রের সমাবেশও করা হয়। মুর্তা বেতের পাটি শিল্প সিলেটকে দেশে বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাটি তৈরিতে হিসাব হল ৪ বেতে এক আনা আর একচিরে থাকে ২০-২০ আনা। পতন, গড়ন ও মুড়ি (জোড়া)-এভাবেই এগিয়ে চলে পাটি তৈরির কাজ। মুর্তা সাধারণত নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর পাড়, ডোবা ও জলাভূমিতে জন্মে। কেউ কেউ ধানের জমিতে, ডোবা বা কর্দমাক্ত ভূমিতে মুর্তা গাছের চাষ করে। প্রাচীন আমলে জৈন্তিয়া থেকে নৌকাযোগে মুর্তা গাছ কিনে আনতে হয়। এখন স্থানীয়ভাবে মুর্তার চাষ হয়। সিলেটের দ্বাস সম্প্রদায় এই পেশার সাথে জড়িত। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সংসারের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে ঘরে বসে পাটি তৈরির কাজে অধিক সময় ব্যয় করে থাকে। এক্ষেত্রে কোন কুসংস্কার নেই। যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, বিবাহিত-অবিবাহিত যে কেউ ইচ্ছেমত পাটি তৈরি করতে পারে। এজন্য তারা কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেননি, বরং পরিবার থেকেই এই পাটি তেরির শিক্ষা লাভ করে থাকে। যতœ সহকারে ব্যবহার করলে একটি শীতল পাটি একাধারে ২৫/৩০ বছরও ব্যবহার করা যায়। বেতের প্রস্থের মাপে শীতল পাটির নামকরণ করা হয়। যেমন সিকি, আধলী, টাকা, নয়নতারা, আসমানতারা, জোড়াকে চিরা প্রভৃতি। তাছাড়া নামকরণ ছাড়াও শীতল পাটি বাজারে পাওয়া যায়। বিভিন্ন পাটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
সিকি
সিকি মুদ্রার সমান প্রস্থ বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের জোড়াছাড়া এই পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ কারিগরের ৪/৫ মাস সময় লাগে। এই পাটি খুব মসৃণ হয়। প্রবাদ আছে যে, মসৃণতার কারণে এই পাটির উপর সাপ পর্যন্ত চলতে পারে না।
আধলী
আধলী মুদ্রার সমান প্রস্থ বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের একটা পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ কারিগরের সময় লাগে জ্জ মাস।
টাকা
টাকা মুদ্রার সমান প্রস্থের বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের একটা পাটি তৈরি করতে কারিগরের সময় লাগে ২/৩ মাস। সবধরনের পাটিতেই কমবেশী জোড়া দিতে হয়। জোড়া তিন প্রকারের- ছিটাজোড়া,দুই জোড়ার চেয়ে ছিটা জোড়া ও তিন জোড়া দেয়া পাটি তুলনামূলক ভাল ও টেকসই হয়ে থাকে। সাধারণত সাড়ে তিন হাত প্রস্থ ও পাঁচ হাত দৈর্ঘ্যরে বিভিন্ন প্রকার পাটি তৈরির সময়কাল ও ক্রয়মূল্য এরকম শীতল পাটি তৈরি করতে সময় লাগে ১ থেকে ২ মাস, দাম ৩ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা। রঙিন বেতের পাটি, সময় ৭ থেকে ১০ দিন, দাম ৩শ টাকা থেকে ৫শ টাকা। সরু বেতের পাটি তৈরিতে সময় লাগে ১ থেকে দেড় মাস। দাম ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, সাদা বা সাধারণ পাটি তৈরিতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ দিন। দাম ২৫০ টাকা ৩৫০ টাকা। কমলকোষ পাটি তৈরিতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন। এর দাম পড়বে ২শ’ থেকে ২৫০ টাকা। আরও আছে আড়–য়া এবং তাজমহল পাটি। তাজমহল পাটি নামকরণের কারণ হল, এটি তাজমহলের চবি সম্বলিত। এটি তৈরিতে অনেক সময় লাগে। দামও অনেক বেশি। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার অনেক থানাতে শীতল পাটি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বালাগঞ্জ ও দাসের বাজার শীতল পাটির জন্য প্রসিদ্ধ। বড়লেখা থানার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দাসের বাজারে প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার নানা জাতের পাটির বিশাল হাট বসে। প্রতি বাজারে পাটি ওঠে প্রায় ১শ’ থেকে ৪শ’টির মত। প্রতি বাজার বারে পাটির বিক্রয় মূল্য লক্ষাধিক টাকায় দাঁড়ায়। পাটি খুচরা ও পাইকারী বিক্রয় হয়। তারপর এই বাজার থেকে পাইকাররা পাটি কিনে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। ওপরের এইসব তথ্য জানালেন স্থানীয় দাসের বাজারের কারিগর মতিলাল দাস ও নলিনীকান্ত দাস।
পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই শীতল পাটি সমাদৃত হয়ে থাকে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানী, জাপান, ফ্রান্সসহ আরও অনেক দেশেই এর চাহিদা রয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোতে এই শীতল পাটি ডেকোরেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিয়ে, শ্রাদ্ধ, বর-কনে সাজাতে এই পাটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সিলেটের হিন্দু-মুসলিম সকলেই বিয়ের কনের সাথে একটি শীতল পাটি উপহার দিয়ে থাকেন, মুসলিমরা নামাজের পাটি হিসেবেও এটি ব্যবহার করেন। কথিত আছে, দাসের বাজারের রূপালী বেতের শীতল পাটি মুর্শিদ কুলী খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দুর্লভ এই হস্তজাত কুটির শিল্পের বিকাশ ব্যহত হচ্ছে। হতদরিদ্র পাটি শিল্পীরা কৃষিকাজ বা অন্যান্য শ্রমযুক্ত কাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি অনেকে মধ্যপ্রাচ্যেও পাড়ি জমাচ্ছেন। কারণ, এই পাটি তৈরি অত্যন্ত শ্রমনির্ভর কাজ। সময় লাগে বেশি এবং তুলনামূলক লাভও হয় কম। এছাড়া পাটি তৈরির উপাদান-মুর্তা, রং ইত্যাদি সহজলভ্য না হওয়াতে পাটি শ্রমিকরা জীবিকা নির্বাহের জন্য বিকল্প কাজ খুঁজছেন। স্থানীয় পাটিশিল্পীরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন- সরকার যেন আবাদি খাস জায়গাকে মুর্তা চাষের জন্য বরাদ্দ করে দেন এবং পার্টি শ্রমিকদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেন। তাহলেই হয়ত এর রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

পাথারিয়া : ২৫ মাইলের সবুজ অরণ্য



শাহীন আহমেদ
পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ, নিচে থরে থরে সাজানো আকাশ চুম্বি পাথারিয়া পাহাড়। এখানে আকাশের কোনো অহংকার নেই। বিশাল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্ববিধাতা যেনো পাহাড়টিকে তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে রূপায়িত করেছেন। ২৫ মাইল ব্যাপী এর বিস্তার। ধারণা করা হয়, এই পাহাড়ের জন্ম মায়োসিন কালের মধ্য ভাগে, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগের। এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ। এখানে আগর নামে এক ধরনের গাছ পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম এগলাইরিয়া এগাইলকা, এর থেকে মূল্যবান আতর তৈরি হয়, যার কদর রয়েছে সৌদি আরব থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পুরো আরব জুড়ে। ওখানে প্রতি কেজি আতরের দাম আনুমানিক দশ থেকে পনের লাখ টাকা। মূল আগরকাঠ জ্বালিয়ে রাখলে পারপাশে সুগন্ধিতে ভরে ওঠে। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ, এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৫৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে পড়ে। তিনদিন তেলের বন্যা বয়ে যায়। আজও কাঠালতলী অঞ্চলে ধানি জমিতে কৃষকের লাঙ্গলের ফলা থেকে জলযুক্ত মাটিতে তেল ভেসে ওঠে। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ তেলকূপের ঢাকনির ওপর কান রাখলে তেলের গমগম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। পাহাড়ে বাঘের বাচ্চা মায়ের দুধ খাবার সময় মাটিতে দুধ পড়ে যেতো। সে দুধ শুকনো হয়ে জমাট বেঁধে থাকত। এটি অত্যন্ত দুর্লভ ছিল। পরে তা সংগ্রহ করা হতো। বাঘের দুধ দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ তৈরি করা হতো। কবিরাজরা অত্যন্ত কষ্ট করে তা সংগ্রহ করতেন। পাহাদে হরহামেশা পাওয়া যেত হাতি, হাতির দাঁত, গ-ারের চামড়া ও মধু। সবচে জরুরি যে জিনিসটি পাওয়া যেত তা হচ্ছে খনিজ জল। পাহাড়ের দক্ষিণপ্রান্তে সাঙ্গন (হাঙ্গন) পেতে গ-ার ধরা হতো। এর নামকরণ হয়েছে পাতিলাসাঙ্গন। খেদা করে ধরা হতো হাতি। এজন্য এর নাম রাখা হয় গজভাগ। এক সময়ে বড়লেখার আদিত্য পরিবারের তত্ত্বাবধানে গজভাগ থেকে হাতি ধরে মুর্শিদাবাদ ও দিল্লিতে চালান দেওয়া হতো। অন্যরা গ-ার শিকার করতে প্রস্তুত করতো ঢাল। তা চালান দিতো পুরো ভারতে। পাথারিয়া পাহাড়ে বেশ ক’টি লবণ খনি ছিল।
পাথারিয়া পাহাড়ের বাঘ, পাখি, হরিণ, হাতি, হাতির দাঁত, বন্য শুকরসহ নানা ধরণের পাখি, মূল্যবান গাছপালার স্মৃতিময় ডালা এখন স্থানীয় মুরব্বীদের মুখে নস্টালজিয়া মাত্র। চল্লিশের দশকে পাথারিয়া পাহাড়ের কি অবস্থা ছিল উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার জবানিতে তা এভাবে ফুটে ওঠে- ‘আমাদের গাঁ থেকে পাথারিয়া পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল পর্যন্ত চার মাইল দীর্ঘ গোটা পথটি গাছগাছালিতে নিবিড় ছিল, কাঠালতলী স্টেশন পেরিয়ে মাইল খানেক পূর্বে গেলেই বনমোরগ, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ, বানর দেখা যেত। আরেকটু এগোলেই শোনা যেত হনুমানদের একঘেয়ে জিগির, দৈবাৎ হরিণের ডাক। আশংকা ছিল বুনো শুকরের সঙ্গে মোলাকাতের। পাহাড়ের কাছে আমাদের একটি ছোট বাড়ি আছে। কৈশোর থেকেই সেখানে যাতায়াত, বসবাস। কত যে বিচিত্র পাখি দেখেছি, রামধনুর সাতরঙের বেশি রঙধারী পাখি ছিল। পাকুড় গাছে ফল পাকলে আসত হরিয়ালের ঝাঁক। আজ আর তার একটিও টিকে নেই। একদিন পাহাড়ের উঁচু টিলার চুঁড়োয় পৌঁছাই। হাপাতে থাকি, এক উঁচুতে আর কোনোদিন উঠিনি। অবাক হয়ে চারদিকে তাকাই। এমন আশ্চর্য দৃশ্যপট কোনোদিন দেখিনি। পূর্বে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের পর পাহাড়, পশ্চিমে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, জলাভূমি, আঁকাবাঁকা নদীর রেখা, তারপর আকাশ আর মাটির মেলামেশা। হঠাৎ চোখে পড়ে নিচে যেন পাহাড়ের গা-ঘেঁষে পোকার মতো কী একটা হাঁটছে! আসলে ওটা চারমাইল দূরের রেলপথে চলমান একটা ট্রেন। তখনই এই বিস্তীর্ণ নিসর্গ দৃশ্যের দূরত্ব সম্পর্কে বোধোদয় হয়। রেল সড়কের লাগোয়া আমাদের গ্রামটি পাহাড়ের গায়ে যেনো সেঁধে আছে, দূরের উজ্জ্বল জলরাশি দশ-পনের মাইল দূরের হাকালুকির হাওর এবং তারপর জেলা সদর সিলেট পর্যন্ত খোলা মাঠ। হঠাৎ দেখি নিবিড় বনের ফাঁক গলিয়ে একগুচ্ছ আলো, পাতাগুলো ঝলমলিয়ে উঠেছে। তারপর দেখি বাঘের তরতাজা পায়ের দাগ, আমরা তখন জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ের সাঁওতাল পল্লীর দিকে দ্রুত দৌড়াতে থাকি।’ পাথারিয়া পাহাড়ের প্রাকৃতিক অবস্থা সম্পর্কে দ্বিজেন শর্মাকে মনে হল যেন সাক্ষাৎ উদ্ভিদ জগতের মহারাজা। তিনি শোনান- ‘পাহাড়ে বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, পাথর, পাথরের গায়ে রেশমি সবুজ শ্যাওলার আস্তর। ঢাউস পাতার বুনো রাম কলার জোঁপ, হলুদ হয়ে ওঠা ঘাস, আমাদের পাহাড়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ দেখেছি। অশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাপা, পারুল, জংলী, জুঁই, নাগপল্লী, লুটকি, নীললতা, ল্যাডিস আম্রেলা, ডুলিচাপা, ম্যাগনলিয়া আরও কতো নাম না জানা ফুল, ফল, পাখি, জীব, জন্তু দেখতে পাওয়া যেত।’
নবাবী আমলে পাথারিয়া পাহাড় ও এর আশপাশের জঙ্গল ছিল কুকিদের আস্তানা। এক সময় এ অঞ্চলে কুকি নয় এমন মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। কুকিরা মানুষের মাংস খুব পছন্দ করত। প্রায়ই তারা সমতল অঞ্চলে হানা দিয়ে নর-নারী ও শিশু বন্দি করে নিয়ে যেত। ছাগল বা ভেড়ার পালের মতো চালান করা হতো তাদের আস্তানায়। এসব বন্দিদের অনেককেই জবাই করে উদরপূর্তি করা হতো। তবে সুন্দরী নারী থাকলে তাকে তারা রেখে দিত অথবা উপহার স্বরূপ ত্রিপুরা বা অন্য কোথাও পাঠাতো। পাথারিয়া পাহাড়ে রয়েছে দূরবীন টিলা, গজনটিলা ও রাজবাড়ি নামে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ২৪৪ মিটার। আর হাতের মাপে ৫৩৪ হাত। একতলা দালানকে যদি ৮ হাত ধরা হয়, তবে এর উচ্চতা হবে বাংলাদেশের শিল্প ব্যাংকের মতো প্রায় ৩টি উঁচু দালানের মতো। বর্তমানে পাথারিয়া বনাঞ্চলকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও মানবসৃষ্ট বনাঞ্চল। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্তে এই বনাঞ্চলকে তিনটি বিটে বিভক্ত করা হয়েছে এগুলো হলো- ক. বড়লেখা বিট, খ. মাধবছড়া বিট, গ. সমনবাগ বিট। তিনটি বিটের মোট ভূমির পরিমাণ ৯১৮৭.৫৫ একর। বর্তমানে পাথারিয়া বনাঞ্চলে রয়েছে শুধু বাঁশ, বেত ও কিছু গাছ-গাছড়া। মূল্যবান বৃক্ষ বলতে কিছু নেই। চাম, সুন্ধি, করই, বামঢালা, গামারি, চাপালিকা, জারুল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের মূল্যবান বৃক্ষে সমস্ত বনাঞ্চল ছিল ভরপুর। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে চারটি মহালে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- ক. নিকড়ি বাঁশ মহাল, খ. ষাটমাছড়া বাঁশ মহাল, গ. মাধবছড়া বাঁশ মহাল এবং ঘ. লাতু ধলছড়া বাঁশ মহাল।
পাথারিয়া পাহাড় নিয়ে একটি জনশ্রুতি এরকম, সুদূর অতীতকালে বাঁশ কাটতে গিয়ে এক দিন মজুর এক কলসি সোনার মহর পেয়েছিল। পাহাড়ের বাঁশ শ্রমিকেরা আজও গভীর জঙ্গলে গাছের পাতার ফাঁক ফোকরে গভীর মনোযোগে সোনার মহর খুঁজে থাকেন বলে স্থানীয়রা জানান। পাথারিয়া পাহাড়ের হরিণ খাওয়ার লোভে বাঘ পাহাড়ের নিচে জনারণ্যে চলে আসত। পাথারিয়া পাহাড়ের হরিণ খাওয়ার লোভে বাঘ পাহাড়ের নিচে জনারণ্যে চলে আসত। পাথারিয়া পাহাড়ের গভীর অরণ্যে মাধবকু-ের তৎকালীন বাসিন্দা শ্রী কালী প্রসন্ন দাসের সাথে আলাপ হয়। তিনি ৭০ দশকের গল্প আমাদের এভানে শোনান- ‘মাধবকু-েই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পাহাড়ে বাঘের অবস্থা ছিল অনেকটা গ্রামের শেয়াল দেখার মতো। আমরা বর্ষা মৌসুমে একটা, দুটো কিংবা তার চেয়ে বেশি বাঘ দেখতাম। মাধবছড়ায় বাঘকে পানি থেকে কিংবা চা বাগানের সরু পথ দিয়ে বাঘকে লেজ নেড়ে যেতে দেখেছি। কতোদিন স্কুলে যেতে কিংবা স্কুল থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলায় বাঘের মুখোমুখি হয়েছি। একদিনের ঘটনা, শৈশবে আমি আমাদের বাড়ির গৃহভৃত্যের কোলে ছিলাম। এ সময়ই বাঘ এলো গরুর উপর আক্রমণ করতে। বাঘ দেখে সুরেন্দ্র মামা তীব্র হুংকার দিলে বাঘ চলে যায়। বাঘ মামার সাথে সুরেন্দ্র মামার ধমকাধমকির স্মৃতি আমার মন থেকে আজও মুছেনি। আমাদের অনেকগুলো গাভী ছিল, বাঘ প্রায়ই গাভীদের উপর আক্রমণ করতে আসত। উপায়ন্তর না দেখে বাঘ মারার জন্যে বন্দুকধারী শিকারী কাঁঠাল গাছের ওপর মাঁচা করে ওৎ পেতে বসলেন। বন্দুকে গুলিভরা, বাঘও এলো, কিন্তু ছুঁড়তে পারলেন না। পাহাড়ে বাঘ ছাড়াও এক পাল বন্যহাতি আসত। পাহাড়ে আমি জন্মের পর দু’যুগ ছিলাম যেখানে আমাদের বাড়ি ছিল, আজও সেখানে বাঙালি জনবসতি গড়ে ওঠেনি।’ সত্তর দশকের অরণ্যে লালিত এই শিশুসন্তানটি বর্তমানে ঢাকার সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। পাথারিয়া পাহাড়ের বাঘের ব্যাপারটা স্থানীয়দের কাছে মুখরোচক গল্পের বিষয়। জনশ্রুতি আছে বাঘ মানুষকে খেলেও পীর-ফকির, সাধু-সন্নাসীদের সাথে ভাল ব্যবহার করত। এমনকি বাঘ পীরদের পোষ্য কুকুরের ন্যায় খাদিমের মতো কাজ করত। অতীতকালে স্থানীয়দের অদ্ভুত একটি ধারণা ও লোকাচার ছিল। যদি কারও সন্তান না হতো তবে বাঘের গায়ের ওপর পা রেখে স্নান করলে তিনি সন্তান ধারণ করতে পারবেন। এতে বাঘ এলা’ দূর হবে। এরকম একটি ঘটনার উদাহরণ ঘোলসা এলাকায় প্রায় ৯০ বছর বয়ঃবৃদ্ধ শ্রীমতি তরঙ লতা দাস। বিয়ের অনেক বছর পরও সন্তান না হওয়ায় শাশুড়ী তাকে এই কাজে উৎসাহ যোগান। এলাকায় তখন শীত মৌসুমে প্রচুর বাঘ শিকার হতো। তিনি মৃত বাঘের উপর পা রেখে স্নান করেছিলেন। শুরুতে ভয়ে তার পিলে চমকে গিয়েছিল। তখন শ্বশুড়বাড়ির সবাই তাকে সাহস যুগিয়েছিল। এর কিছু দিন পর তিনি প্রথম সন্তান ধারণ করেন। তরঙ্গলতা দাস অরণ্য শোভিত পাথারিয়া পাহাড়ের ৫০ বছরের সচক্ষু দর্শক। তার সাথে বাঘের কতো যে দেখা হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ছড়া থেকে জল আনতে গিয়ে প্রায় তিনি বাঘদের খপ্পড়ে পড়তেন। তবে অত্যাশ্চর্য হলো বাঘরা কখনো তাকে আক্রমণ করেনি। এ যেন এক জংলী রাণীর গল্প। পাথারিয়া পাহাড়ে শীত মৌসুমে গভীর অরণ্য থেকে বাঘ জনারণ্যে নেমে আসত। জঙ্গল থেকে নেমে আসা বাঘ, গরু-মহিষের জান নিলেও সে নিজে জান নিয়ে ফিরে যেতে পারত না। কারণ, স্থানীয়রা বাঘ শিকারে বড়ই ওস্তাদ। বাঘ শিকার হতো শীত মৌসুমে। এটি খুব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হতো। পাহাড়ে বাঘ দেখা গেছে বা কারো বাড়িতে আক্রমণ করেছে অথবা কারও বাড়িতে বাঘের পদচিহ্ন কিংবা বাঘের গর্জন শোনা গেছে এসব খবর পাওয়া মাত্রই বাঘ শিকারের আয়োজন শুরু হতো। মসজিদে দেওয়া হতো ঘণ্টা। দলে দলে লোকে মসজিদে ছুটতো। জাল ধুয়ে সাফ করা হতো। কুচ বল্লম (জাটা) দা, খুন্তি, কুঠার সব শান দেওয়া হতো। তারপর দিন ঠিক করে দোয়া মাহফিল। হিন্দুরা পুজো ও ভগবানের কাছে আশির্বাদ চেয়ে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা পাহাড়ের দিকে বাঘ শিকারে রওয়ানা দিত। এভাতে ১৬টি পঞ্চায়েতের হাজার হাজার মানুষ জালজাটা নিয়ে পাহাড়ে একত্রিত হতো। তখন পাহাড়ে উৎসব ভাব চলে আসত। রীতিমতো বাজার বসে যেত। তবে লোকজন গাছপালা ও পরিবেশের প্রচুর ক্ষতি সাধন করত আগুন জ্বালিয়ে, হাঁক দিয়ে, ঢোল বাজিয়ে, হু হু আদিম চিৎকার, যত্রতত্র জলবিয়োগ ও পুরিষ প্রক্ষালন করে। হিনাই নগর, পাখিয়ালা, অজমীর, সাতকরাকান্দি, সুজানগর, এরকম ১৬টি পঞ্চায়েতের নিজস্ব জাল ছিল। বাঘ যেখানে লুকিয়ে থাকত শিকারিরা তাকে ‘ধুর’ বা ‘লুৎ’ বলে। এই লুতের মধ্যে শিকারিরা জাল পেতে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখত। জালের নিকট সাহসী ও সাবধানী ৫/৭ জন শিকারি সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত। বাঘ সব সময় পিনপতন নিরবতার মধ্যে বসবাস করে। দূর থেকে অন্যদের হৈ হুল্লোর ও ঢাক ঢোলের শব্দে বাঘ লুতে পালাতে গিয়ে শিকারিদের জালে ধরা পড়ত। আবার গড় বেঁধে ও বাঘ ধরা হতো। গড়ের মধ্যে ছাগল দিয়ে রাখা হতো। ছাগলের চিৎকারে বাঘ এলে শিকারি জাল দিয়ে বাঘ ধরে ফেলত। তারপর কিছুদিন অভুক্ত রেখে, বাঘের সাথে মজা করে, বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে বাঘকে মেরে ফেলা হতো। যাদের জালে বাঘ ধরা পড়ত, শুধু তারাই বাঘ মারার মূল হকদার। বাঘকে মেরে ফেলার পর কাঁধে নিয়ে গ্রামে গঞ্জে সবাইকে দেখানোও হতো। এইসব বাঘ শিকার দেখতে জেলা সদর থেকে এসডিওরাও আসতেন। বাঘ শিকারের শৈশব স্মৃতি হিসেবে বিশিষ্ট প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. আতাউল করিম এক সাক্ষাতকারে বলেছেন- ‘সে সময় আমাদের এলাকায় বছরে তিন থেকে চারটি বাঘ ধরা পড়ত। আর বাঘ ধরা মানে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়া। স্কুল ছুটি মানে একসঙ্গে তিন চারদিন। পাহাড়ি এলাকায় গড় বেঁধে বাঘ ধরা হতো।... উল্লেখ্য ড. আতাউল করিমের গ্রামের বাড়ি পাথারিয়া পাহাড় থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে অবস্থিত। ৮২ বছর বয়সের বাঘ শিকারি হাজী মতছিম আলী মতই মেম্বার সাহেবের সাথে আমাদের আলাপ হয়। তিনি প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি বাঘ ও ৩০০ থেকে ৪০০ হরিণ শিকার করেছেন। তার জীবনের স্মৃতিময় ঘটনা হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করা। ১৩৬৬ বাংলার ২২ জৈষ্ঠ্যের এই দিনে তাদের কাছে খবর এল কেরামত নগরে বাঘ দেখা গেছে। ব্যাস, আর কোন কথা নেই। বাঘ শিকার তার রক্তের সাথে মিলিত একটা নেশা। তিনি তার সাহসী গুরু নেছার আলীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। গাছে মাঁচা বেঁধে বাঘের আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন। দু’চোখে টর্চলাইটের মতো আলো জ্বালিয়ে বাঘ এল। এরপর বাঘকে তারা গুলি করে মেরে ফেলেন। এই বাঘটি লম্বায় ছিল সাড়ে সাত হাত। তার জীবনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা হল, একবার কেছরিগুল এলাকায় গড় বেঁধে বাঘ শিকার করা হলো। রাত্রে গড়ের মধ্যে বাঘকে আটকে রাখা হয়। কিন্তু দিনের বেলা বাঘ গড় ভেঙ্গে ফেলে। উপস্থিত লোকজন ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। শুধু গুরু নেছার আলী আর আমি বাঘের সাথে মোকাবিলা করি। বাঘ তখন নেছারের একহাত কামড়ে ধরে আর নেছার আলী অন্য হাতে বাঘের জিহ্বা টেনে ধরে। তারপর গুলি করে আমি বাঘটাকে মেরে ফেলি। এই ঘটনায় নেছার আলী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হোন। তাকে ভালো চিকিৎসার জন্যে আসামে পাঠানো হয়। তৎকালীন সরকার তাকে একটি বন্দুক উপহার দেন। এরকম আরও বাঘ শিকারিরা হলেন- পাখিয়ালার- বশির আলী, আইউব আলী, জোনাব আলী, রঈছ আলী, মুছব্বির আলী, হিনাইনগরের বাট্রিসত্তর, নিজবাহদুর পুরের আবজল। দরগা বাজারের জওয়াইদ আলী, মুছিম আলী, নজীব আলী প্রমুখ। বাঘ শিকার নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এরকম স্থানীয় কেছারিগুলের আফজাল মিয়া শিকারকৃত মৃত প্রায় বাঘের মুখে দয়াপরবশ হয়ে পানি দিলে, বাঘ তার শরীরে প্রাণ ফিরে পায় এবং আফজাল মিয়াকে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। এতে পুরো এলাকায় হায় হায় রব ওঠে। পরে আফজাল মিয়াকে নিয়ে বাংলা পুঁথি রচিত হয়। বাঘ শিকারের এইসব অদ্ভুত তথ্য জানান স্থানীয় ফখরুল ইসলাম সোহাগ ও নজীব আলী। পাথারিয়া পাহাড় এখন আগের মতো নেই। এখন এখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাক ও নানান জাতের গাড়ি চলছে। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ, পাখিদের গুঞ্জন নানান রকমের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও টেম্পু ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। চলছে পুকুর খনন। দালান উঠছে। দোকান পাট বসেছে, বসেছে ইটভাটা আর করাতকল, বন ছাই হচ্ছে ইটলোকার জ্বালানী হয়ে। অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। দেখার লোক আছে। হায়! ঠেকাবার কেউ নেই।

সিলেটের সাঁওতাল



শাহীন আহমেদ
বড়লেখার অরণ্যশোভিত পাহাড়ি এলাকায় সবুজ চা বাগানের মাঝে এক বুক কষ্ট নিয়ে কোনভাবে বেঁচে আছে সাঁওতাল সম্প্রদায়। ‘গাছ ছিলালে রুপিয়া মেলে’ এই লোভ দেখিয়ে বৃটিশরা ভারতের উড়িষ্যা থেকে এদের নিয়ে আসে। দু’শো বছরেরও বেশি সময় আগে আসা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী সিলেটের লাল মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে আজও। চা শ্রমিকের পোশাকে এখন তারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বাংলাদেশি হিসেবে। এতটুকুই তাদের উত্তোরণ। কিন্তু তাদের জীবনকাঠামোর কোন উন্নয়ন ঘটেনি। মানবেতর জীবন যাপন পিছু ছাড়ে না তাদের। এদেরকে কুলি বা লেবার বলেই সম্বোধন করা হয়। পাথারিয়া সাঁওতাল পল্লীতে প্রবেশের পর বেশ বিপাকে পড়া গেল। এরা কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের ঐতিহ্যবাহী তীর ধনুকের ছবি ওঠাতে দিতে আগ্রহী নয়। স্থানীয় ফখরুল ইসলাম সোহাগ একজন বয়োবৃদ্ধ ভদ্রমহিলার কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন। তিনি সাঁওতালদের কাছে ‘বড় মা’ বলে বিশেষ পরিচিত। সাঁওতাল পল্লীতে তার প্রতাপ চোখে পড়ার মতো। চা শ্রমিকদের বউরা গর্ভবতী হলে তিনি একজন ‘দাইমা’ হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই তার এত কদর। ‘বড় মা’ ছোট বাঁশেখর লাঠিতে ভর করে শুক্রাম বলে হাক দিতেই সাঁওতাল পল্লীর ছোট বড় সবার মাঝে সাড়া পড়ে গেল। শুক্রাম হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বসার ব্যবস্থা করতে লাগল। কাঁচা সুপারি আর পান দেওয়া হলো আমাদের। জমে উঠল গল্পের আসর। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মত সাঁওতালদেরও রয়েছে বৈচিত্রময় জীবনযাত্রা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারা। এদেশে অধিকাংশ সাঁওতালদের বচবাস রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলাতে হলেও দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। নৃতাত্বিক বিশ্লেষণে সাঁওতালদের আদি অস্ট্রেলীয় পরিবারের অন্তর্ভূক্ত একটি বংশ বলে জানা যায়। সিলেটের সাঁওতালরা ভারতের নাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে বলে জানা যায়। কর্মঠ দেহের অধিকারী সাঁওতালদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এছাড়াও সাঁওতালদের পালিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুটে উঠতে দেখা যায় সভ্যতার আদি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। সাঁওতালদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রকৃতি পূজার বৈশিষ্ট্য। সাঁওতালদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস আছে কিন্তু কোনও ধর্মগ্রন্থ নেই। ভাষা আছে কিন্তু বর্ণ নেই। তারপরেও এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকায় কোন শঠতা, মিথ্যাচার নেই বললেই চলে। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চোখে পড়ে। সমাজ ঘটিত যে কোনও অন্যায় অপরাধের বিচার তারা সামাজিকভাবেই সমাজ প্রধানের দ্বারা নিষ্পত্তি করে থাকে। তাদের সামাজিক ব্যবস্থায় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রাধান্য পায়। বিচার ব্যবস্থার প্রথম স্থরে রয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। যার সদস্য সংখ্যা ৫। এরা হলো- মাঝিহাড়াম, জগমাঝি, পরাণিক; গোডেৎ ও নায়েকে। নায়েকেকে তারা সাধারণ পঞ্চায়েতের সদস্য নয় বলে শুধু ধর্ম গুরু বা পুরোহিত হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। সাঁওতালরা পিতৃপ্রধান পরিবারের লোক। তাদের সমাজে পিতার সূত্র ধরে সন্তানের দল ও গোত্র (বংশ) পরিচয় নির্ণয় করা হয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে সমৃদ্ধি সংস্কৃতি সত্ত্বা লক্ষ্য করা যায়। এদেশে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো সাঁওতালদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বনসহ সব উৎসবেই নৃত্যগীত একটি অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, পূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নানা লোকাচার সংস্কার দেখা যায়। সাঁওতাল সমাজেও রয়েছে গোত্রপ্রথা। স্বগোত্র বিবাহ এদের সমাজে নিষিদ্ধ। আর এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোনও ছেলে মেয়ে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে সমাজ তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে। সাঁওতালদের রয়েছে বারটি গোত্র। যেমন- হাসদা, কিস্কু, মুর্মু, হেমব্রম, মার-ি, সোরের, টুভু, বাস্কি, গোয়া সোরেন, বেসরা, পাউরিয়া ও চোঁডে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ে বিবাহ প্রথা চার ধরনের। ডাঙ্গুরা বাপ্পা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে, অঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে, অ-র বা বলপূর্বক বিয়ে, ইতু বা কৌশলগত বিয়ে। উল্লেখিত সকল বিবাহেই আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে রয়েছে বাদ্য ও নৃত্য গীতের আয়োজন। এদের প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানে নেশাজাতীয় পানীয় মদ বা হাড়িয়া পান প্রচলিত। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে তাদের লোক সঙ্গীত। সঙ্গীতের সাবলীল সুরের মুর্ছনা ও নৃত্য ভঙ্গিমা মোহনীয় পরিবেশ এনে দেয়। সুঠাম ও কর্মঠ দেহের অধিকারী সাঁওতালদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এছাড়াও সাঁওতালদের পালিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুটে উঠতে দেখা যায় সভ্যতার আদি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, মারাং বুরু দেবতাই তাদের প্রধান দেবতা। এই বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি করেছেন তিনি। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পার্বনিক উৎসব অনুষ্ঠান একেক এলাকায় একেক নামে অভিহিত হলেও তাদের সম্প্রদায়গত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উপাচার রয়েছে। যেমন, চৈত্র মাসে পালিত হয় বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখ মাসে হোম, জৈষ্ঠ মাসে এরোরা, আষাঢ় মাসে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিন মাসে দিবি, কার্তিক মাসে নওয়াই এবং পৌষ মাসে উদযাপিত হয় সোহরাই উৎসব। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেকেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তবে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিতে এদেশের বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব কিছুটা হলেও পড়েছে। তাইতো হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, মনসা পূজা, শিব পূজা পালন করতে দেখা যায় তাদের। আর এভাবেই আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি রূপরেখা হয়ে ওঠেছে অনেকটা মিশ্র চেহারার সংস্কৃতি। এই সম্প্রদায়ের প্রবল জাত্যাভিমান রয়েছে। কিন্তু দারিদ্র ও শিক্ষার অভাবে এদের সামাজিক সংস্কারগুলো আবদ্ধ। বান, টোনা, ডাইনী সাধন ইত্যাদি সংস্কারের কারণে তাদের মধ্যে প্রায়ই পারিবারিক কলহ ও ঝগড়া বিবাদ ঘটতে দেখা যায়। সাঁওতালরা বিয়ের সময় নানা ধরনের সামজিকতা ও আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এতে বর ও কনের পিতামাতার ভূমিকার সঙ্গে তাদের গ্রামের প্রধান মাঝিহাড়ামদেরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। আনুষ্ঠানিক বিয়েতে ঘটকালি করার জন্য ‘রায়বারি’ ও নিযুক্ত হয়। বরের বড় ভাই অথবা স্থানীয় কোন ব্যক্তি কনেকে দেউড়ির মধ্যে বসিয়ে দেয়। তারপর সাতজন পুরুষ সেটি কাঁধে করে বিবাহ মন্ডপে প্রবশে করে। অপর দিকে বরের ভগ্নিপতি অথবা এ সম্পর্কিত কোনও ব্যক্তি বরকে কাঁধে করে বিবাহ মন্ডপে আসে। কনের পিতা ঘটে রাখা পানি বরের মাথায় ছিটিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ জ্ঞাপন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। বড় ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে কনের গালে পরপর তিনবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। শেষে সিঁদুর পাতের সব সিঁদুর নিয়ে বর বধূর গালে লেপন করে দিয়ে সিঁদুরের পাতাটি তার পিতার হাতে ফিরিয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানের পর বর, বধূকে কোলে করে দেউড়ি থেকে মাটিতে নামায়। এই সময় কেন পক্ষের লোকেরা বর বধূর কাপড়ের আঁচল বেঁধে দেয়। এরপর চলে মদ্যপান ও আমোদ প্রমোদ। সাঁওতাল যুবকদের নেশা শিকার করা। নিজস্ব তীর ধনুক দিয়ে শেয়াল, বিড়াল, কাঠ বিড়ালী যা পায় তাই শিকার করে। ‘কুচিয়া’ নামক এক প্রকার মাছ শিকারে এরা খুব ওস্তাদ। সাঁওতাল নারীদের চেহারা মলিন হলেও মনের দিক থেকে এরা খুবই উদার। যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে খোপায় ফুল সাঁওতাল মেয়েদের চেহারায় আনে বাড়তি সৌন্দর্য।
১৯২১ সালে অত্যাচারে জর্জরিত সাঁওতালরা একযোগে এ দেশ ছেড়ে ট্রেনে চেপে নিজ মুলুকের পথে রওয়ানা হয়। চাঁদপুর থেকে জাহাজে ওঠার চেষ্টারত সাঁওতালদের ওপর পুলিশী হামলা চালিয়ে স্থব্ধ করে দেওয়া হয় সে আন্দোলন। এজন্য চা শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে বলা হয় ‘মুলুকি’ আন্দোলন। বৃটিশরা এদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়নি। বাঙালি চা বাগানের মালিকরাও এদের সঙ্গে একই নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। নামমাত্র মূল্যের বেতনে এরা অনাহারে, কখনো অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। অপুষ্টি ও চর্মরোগসহ নানা রোগে এরা ভুগছে হরহামেশা। এদের ছেলেমেয়েরা দু’একজন স্কুল কলেজে পড়লেও বেশির ভাগই থাকছে শিক্ষাবঞ্চিত। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, এরা আর স্বাভাবিক মানব সমাজে নেই। এদের জন্য বোধহয় বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে।

Wednesday, July 18, 2012

ছোট ধামাই’র মনিপুরী সমাজ



শাহীন আহমেদ
মটরসাইলে এগিয়ে চলেছে। জুরি থেকে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন স্থানীয় শিল্পী ভাগ্য সিংহ। ওপরে নীল আকাশ। নিচে সবুজে ঘেরা চা বাগান। পাহাড়ি শীত গায়ে মেখে আমরা যাচ্ছি ছোট ধামাই’র মনিপুরী পল্লীতে। মৌলভীবাজার জেলার জুরি এর অবস্থান। মনিপুরীরা এখানে বসতি গেড়েছেন প্রায় দুশ’ বছর আগে। ভাগ্য সিংহ আমাদের নিয়ে গেলেন মনিপুরী সমাজ প্রধান খুল আহালের বাড়ি। এগিয়ে এলেন রনজিতা শর্ম্মা। বসলাম অতিথি শালায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তিনি নিয়ে এলেন ঐতিহ্যবাহী মনিপুরী মোয়া, আপেল আর খেজুর। তারপর এলো পেয়ালা ভর্তি চা। জলযোগ শেষ হলো। আমাদের আসরে যোগ দিলেন চন্দ্রধন সিংহ। তিনি মনিপুরী শিল্পকলা একাডেমির সহ-সভাপতি। এরপর জমে উঠল গল্পের আসর।
মনিপুরীরা মঙ্গোলিয়ান গোষ্ঠির তিব্বত-ব্রহ্ম শাখাভুক্ত। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে মনিপুরীরা বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়। তখন মনিপুরের রাজা ছিলেন মহারাজ চিতোম খোস্বা। মনিপুরীরা বিষ্ণুপ্রিয়া, মৈতেই ও মৈতেই পাঙ্গার- এই তিন শ্রেণীতে বিভক্ত। বিষ্ণুপ্রিয়া ও মৈতেই সম্প্রদায়ের লোকেরা হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী। তারা গোড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ভুক্ত। মৈতেই পাঙ্গালরা ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। অষ্টাদশ শতকে মনিপুরী রাজপরিবারে আত্মকলহ দেখা দেয়। এই সুযোগে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের রাজা ব্রহ্মরাজ মনিপুর আক্রমণ করেন। মনিপুরীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে মৈতেই এবং বিষ্ণুপ্রিয়াদের মধ্যে মতভেদ আছে। দীর্ঘদিন বড়লেখায় বসবাস করলেও মনিপুরীদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এখনও অক্ষুণœ আছে। এই পাড়ায় আছে তাদের ম-প ও দেবমন্দির। মনিপুরীদের পাড়াভিত্তিক সংগঠন নাম ‘সিংলুপ’। পাড়ার সকল পরিবার এর সদস্য। সিংলুপ প্রধানের নাম ‘খুলআহাল’। মাতৈ ভাষায় সিংলুপের উচ্চতর পর্যায় হচ্ছে লৈপাক পানচায়’। এর প্রধান হচ্ছেন ‘পানচায় মাকফ’। তাকে সাহায্য করেন ‘ইশে ইশেলপা’ (গায়ক) ‘পুংজৈরা’ অথবা ডাকুলা (মৃদঙ্গবাদক) ‘শাস্বাসা’ (অভ্যর্থনাকারী), আরাঙ পুরেন’ বা ‘আরাংপা (ভা-ারী), মইবুং অংবা (শঙ্খবাদক)। ‘পুরেন’ হচ্ছেন প্রধান ব্রাহ্মণ। তিনি ধর্মীয় বিধি ব্যবস্থার নির্দেশ দেন। তার সহকারী হলেন ‘পুরেন মথাং’। মনিপুরী ছেলেরা পারিবারিক পরিবেশে ধুতি ও গামছা পরে থাকে, তবে বর্তমানে প্রজন্মের ছেলেরা প্যান্ট শার্টই বেশি পরে। মনিপুরী মেয়েরা নিজেদের বোনা এক ধরনের কাপড় পরে থাকে, যাকে মনিপুরী ভাষায় ‘ফানেক’ বলে। এছাড়া মেয়েরা ওড়না জাতীয় ইন্নাফিও ব্যবহার করে। মেয়েদের কেউ কেউ আজকাল শাড়িও ব্যবহার করে। তবে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে ছেলেরা অবশ্যই ধুতি এবং মেয়েরা ‘ফানেক’ ব্যবহার করে। মনিপুরীরা মূলত নিরামিষভোজী। তবে মাছ খেয়ে থাকে। কোনো ধরনের মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, ইত্যাদি মনিপুরীদের জন্য নিষিদ্ধ। অন্যান্য ব্যাপারে খাদ্যভাসে বাঙালি জনগণের অনুরূপ। তারা ‘মায়াংবা’ নামক এক প্রকার ছোট গাছের সুগন্ধী পাতা ও ‘তক পানিংকক’ নামক লতার পাতা মসলা হিসেবে খেয়ে থাকে। রসুন পাতার গন্ধযুক্ত ‘জনাম’ পাতার চাষ দেখা যায় প্রত্যেক মনিপুরী বাড়িতে। বিভিন্ন কাঁচা পাতা দিয়ে তৈরি ‘সেঞ্জু’ নামক সালাদ জাতীয় খাদ্য তাদের খুব প্রিয়।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মনিপুরীদের রয়েছে উজ্জ্বল উত্তরাধিকার। তাদের ধর্মীয় অনুভূতি এই ঐতিহ্যকে দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম মনিপুরী নৃত্যকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেন। ১৯১৯ সালে সিলেটে মনিপুরী বালক-বালিকাদের নৃত্য দেখে তিনি শান্তি নিকেতনে এই নৃত্য শিক্ষার প্রবর্তন করেন। মনিপুরী নৃত্যের মধ্যে রাস নৃত্য সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। ‘খুলংইশৈ’, ‘লাই হারাইবাজাগই’ ও ‘খাস্বা হাইবা’ নামক প্রাচীন লোকনৃত্যের পটভূমিকায় এটি উপস্থাপিত বলে অনেকে মনে করেন। সুদূর অতীতে পরম বৈষ্ণব মনিপুর ভাগ্যচন্দ্র সিংহ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে রাধা কৃষ্ণের লীলার অনুকরণে যে রাম নৃত্যের প্রচলন করেন তা আজও অপরিবর্তিত আছে। সোনা-রূপার বিবিধ কারুকার্যখ-িত এসব নৃত্যের পোশাক-পরিচ্ছদের মধ্যে রয়েছে রেশমের ‘ফুরিৎ’ (ব্লাউজ), ‘পৎলয়’ (ঘাগরা) ও মাইয়ুম (মন্তকাভরণ) ইত্যাদি। সুসজ্জিত কীর্তিনিয়াদের নৃত্য সহকারে দীর্ঘলয়যুক্ত নাম সংকীর্তন তাদের অন্যতম ধর্মীয় অনুষ্ঠান। আরও যেসব নৃত্য মনিপুরী সমাজে প্রচলিত আছে তা হলো লাই হারাওবা জাগোই। এই নৃত্যে প্রকৃতি পূজার পরিচয় মেলে। লাই শব্দের অর্থ দেবতা, হারাওবা অর্থ আনন্দ এবং জাগোই অর্থ নৃত্য। এর ইতিহাস এরকম সৃষ্টিকর্তা যখন জড় ও জীব পৃথিবী সৃষ্টি করলেন এবং পরবর্তীকালে স্রষ্টার মূর্তির অনুকরণে মনুষ্য সৃষ্টিতে সফলতা পেলেন তখন দেবদেবীগণ আনন্দে যে নৃত্য প্রকাশ করেছিলেন তারই নাম দেয়া হয়েছে হারাওবা নৃত্য। তাই লাই হারাওবা নৃত্যে দেখা যায় পৃথিবীর সৃষ্টিতত্ত্ব থেকে শুরু করে গৃহায়ন, শস্যবপন, জন্মমৃত্যু সবকিছুই নৃত্য ও সঙ্গীতের সুর লহরীতে ঝংকৃত হয়। এ নৃত্যের আঙ্গিক অংশগুলো যেমন লৈশেস জাগোই (সৃষ্টিনৃত্য), লৈতা জাগোই (গৃহায়ন নৃত্য) লৈসা জাগোই (কুমারী নৃত্য) প্রভৃতি মনিপুরী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে লোক সংস্কৃতি হিসেবে প্রদর্শিত হয়।
খাম্ব^া থোইবি জাগোই নৃত্যকে মনিপুরী লোক সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ হিসেবে মনে করা হয়। এ নৃত্যে সর্বজনীন প্রেমের রূপ পরিলক্ষিত হয়। থোইবি একজন রাজকন্যা। আর খাম্ব^া দরিদ্র, খেটে খাওয়া এক সাহসী যুবক। যুবক খাম্বাকে পছন্দ করে রাজকন্যা থোইবি। আবার রাজকন্যাকে পছন্দ করে যুবরাজ নোংবান। যুবরাজ নোংবান রাজকন্যার প্রেমে ব্যর্থ হন। এভাবেই এগিয়ে যায় কাহিনী। বর্তমানে এই লোককাহিনী মনিপুরী সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। থাবল চোংবী হলো দলীয় নৃত্য। এই নৃত্যে একজন গায়ক ও একজন ঢোল বাদককে অবশ্যই থাকতে হয়। এ নৃত্যের গানে থাকে জ্যোৎ¯œার আলোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, দেশকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা করে সুখ শান্তিতে ভরে দেবার অপার মিনতি। কেননা, থাবল চোংবী মানেই জ্যোৎ¯œারাতের নৃত্য। অবশ্য এই নৃত্যটির শেষাংশে বিশেষ এক মুহূর্ত থাকে যাকে মনিপুরী ভাষায় বলা হয় ‘লাইরে মা থেক’ বা ড্রাগন আকৃতি। এই নৃত্য পরিবেশিত হয় দোল পূর্ণিমার রাতে কিংবা পরবর্তী কয়েকদিন ধরে। এর জন্য খোলা মাঠ ও প্রচুর জনসমাগমের প্রয়োজন পড়ে। আধুনিক নৃত্যকলার ইতিহাসে মনিপুরী রাস নৃত্যকে একটি উপাখ্যান বললে অত্যুক্তি করা হবে না। যদিও লোকনৃত্যের পরে এ জাতীয় ধ্রুপদী নৃত্যের উত্থান ও বিকাশ। তবুও মনিপুরীদের দ্বারা পরিবেশিত কোনো রাসনৃত্য প্রত্যক্ষ করলে মনে হবে নৃত্য পরিবেশনে শিল্পীর দেহ, মন, প্রাণ যেন যুগ যুগ ধরে নিবেদিত। এ নৃত্যকলাটি বিনম্রতা, প্রেম ও ভক্তি প্রদর্শনের জন্য হয়ে উঠেছে অনন্য। এই নৃত্য নিয়ে লোককাহিনী এরকম- হঠাৎ একদিন ব্রহ্মরাজ মনিপুর আক্রমণ করলে রাজা ভাগ্যচন্দ্র পরাজিত হয়ে আসামে আশ্রয়প্রার্থী হন। আশ্রয়ের ব্যাপারে আসামের রাজা একটি শর্ত জুড়ে দেন যে, যদি তিনি মওহাতি জয়শাকে বশে আনতে পারেন, তবে তাকে আশ্রয় দেয়া হবে। ভাগ্যচন্দ্র ছিলেন আধ্যাত্মিক পুরুষ। তিনি খুব সহজেই ভয়ঙ্কর হাতী জয়শাকে বশীভূত করেন। এই কারণে ভাগ্যচন্দ্রকে জয়সিংহও বলা হয়। মনিপুর পুনরুদ্ধার হলে রাজা মনিপুরে গোবিন্দজিউর বিগ্রহমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে পূর্ণাঙ্গ রামনৃত্য পরিবেশন করেন। রামনৃত্যের পোশাক-পরিকল্পনা করেছিলেন স্বয়ং রাজা। এই পোশাকে ফুটে ওঠে মার্জিত রুচি, নম্রতা ও কমনীয়তা। রামনৃত্যে শিল্পীর পরিহিত পোশাকের নাম ‘পলয়’। পলয়ের রয়েছে বিভিন্ন অংশ। মাথার ওপরে থাকে ‘কোকুতস্বী’। মুখের ওপর পাতলা স্বচ্ছ আবরণে থাকে ‘মাইমুখ’, গায়ে ঘন সবুজ ভেলভেটের ব্লাউজ। তাতে সোনালি ও রুপালি চুমকির কাজ। পরনে ঘন সবুজ রঙের পেটিকোট যা শক্ত বক্রম দ্বারা গোলাকৃতি ও ভাজমুক্তভাবে তৈরি করা হয়। এতে বসানো অজস্র চুমকি ও আয়নার কাজ আলোতে ঝলমল করে ওঠে। এই পোশাকের নাম ‘কুমিন’। এছাড়া জরির কারুকাজ করা পেশোয়ান খাওন, খাংনপ ইত্যাদি পলয়ের অংশ। অবশ্য কলথা খাংচিক, খুঁজি ইত্যাদি স্বর্ণালংকারও শিল্পী পলয়ের সঙ্গে পরিধান করে থাকে। বাংলাদেশে রামনৃত্যের সূচনা হয় সম্ভবত ১৮৬৮ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো এক সময়কালে। রামনৃত্য বেশ ব্যয়বহুল। পূর্ণাঙ্গ রাসনৃত্যানুষ্ঠান করার জন্য দরকার পড়ে এক থেকে দেড় ডজন পলয়। টাকার অংকে হিসেব করলে দাঁড়ায় প্রায় দু’লাখ টাকা। মনিপুরী সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো থাঙ-তা জাগোই বা তলোয়ার-বর্শা নৃত্য। মনিপুরী থাঙ-তা জাগোই অনেকটা কোরীয় মার্শাল আর্ট ফর্মের মতো। এর তাল ও লয় গাণিতিক ছন্দে বাঁধা। এই কলা রপ্ত করার জন্য ধৈর্য্যশক্তি ও সুঠাম দেহের প্রয়োজন। হালে বাংলাদেশে মনিপুরী থাঙ-তা আট ফর্মের জনপ্রিয়তা লক্ষণীয় মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে।
মনিপুরী হস্তশিল্প অনেকটা উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত। তাঁত শিল্পের সঙ্গে মনিপুরীদের রয়েছে যুগযুগান্তরের সম্পর্ক। মেয়েদের তাঁত শিল্পের অভিজ্ঞতাকে বিয়ের ক্ষেত্রে পূর্বযোগ্যতা হিসেবে দেখা হয়। ছোট ধামাই’র প্রায় ১২০টি মনিপুরী পরিবার এই তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত। মনিপুরীদের বস্ত্র তৈরির তাঁতকল বা মেশিন প্রধানত তিন প্রকার যেমন, কোমরে বাঁধা তাঁত, হ্যান্ডলুম তাঁত ও থোয়াং। এই তাঁতে সাধারণত টেবিল ক্লথ, স্কার্ফ, লেডিস চাদর, তোয়ালে, মাফলার, গামছা, মশারী, ইত্যাদি ছোট কাপড় তৈরি হয়। প্রধানত নিজেদের তৈরি পোশাক দ্বারা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতেই মনিপুরী সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁত শিল্প গড়ে উঠে। এর ফলে তাঁত শিল্পে নির্মিত সামগ্রী বাঙালি সমাজে নন্দিত ও ব্যবহৃত হয়। বিশেষ করে নকশি করা ১২ হাত মনিপুরী শাড়ি, নকশি ওড়না, মনোহারি ডিজাইনের শীতের চাদর বাঙালি মহিলাদের সৌখিন পরিধেয়।
রাজধানী শহরে কুমুদিনী, আড়ং, প্রবর্তনা প্রশিকা প্রভৃতি বিপণী কেন্দ্রে মনিপুরী তাঁত শিল্পে প্রস্তুতকৃত সামগ্রীর কদর দেখা যায়। আন্তর্জাতিক বাজারেও এর চাহিদা রয়েছে। সময়োপযোগী উন্নত প্রশিক্ষণ পেলে এই সম্প্রদায় দেশের তাঁত শিল্পের উন্নতিও বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে। জানালেন স্থানীয় সাংবাদিক রফিক আহমদ। ছোটধামাইতে মনিপুরীদের বেশ কিছু নিজস্ব সংগঠন চোখে পড়ল। ছোট ধামাই শিল্পকলা একাডেমি, বাংলাদেশ পৌরে আপাকপ মৈতেই উল্লেখযোগ্য। মনিপুরীদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে এটি কাজ করে যাচ্ছে এবং মনিপুরী গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান করে থাকে।
মনিপুরী সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো নাট্যচর্চা। রণজিৎ কুমার সিংহের রচনা ও নির্দেশনায় এখানে বেশ কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো হচ্ছেÑ মৈতান, ওযাশক্কী কোলোয়দা, পুন্দিলম্বি অমদা, ভাগমহৈ রূপ ইত্যাদি।
ছোট ধামাই শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষক ভাগ্যসিংহ জানালেন, যথাযথ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া গেলে অদূর ভবিষ্যতে মনিপুরী তাঁত শিল্পের ওপর তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হতো। মনিপুরীদের মাঝে কিছু কুসংস্কার আছে যেমনÑ বৃহস্পতি ও শনিবারে যাত্রা অশুভ। কোনো শুভকাজের সূচনাতে বিধবা রমণীদের মুখ দেখাও অশুভ। মনিপুরীদের আছে বার মাসে তের পার্বণ। চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে সবচে’ বড় উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। শাজিবু চাই রওবা। এই অনুষ্ঠানে থাকে বিভিন্ন ধরনের আনন্দ আর খাওয়ার আয়োজন। এরা মৃতদের জন্য ১৫ দিন তর্পণ বা প্রার্থনা করে। তখন ধর্মগ্রন্থ পাঠ করা হয়। মনিপুরীদের যেকোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সবচে’ বেশি বাজানো হয় মৃদঙ্গ।

হাকালুকি হাওর কখনও সাগর কখনও ধু ধু মাঠ...


শাহীন আহমেদ

হাকালুকি হাওর। পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল নিম্নাঞ্চল জুড়ে এই হাওরের ভৌগলিক অবস্থান। জুরি আর পানাই এই দুই নদীতে পানির প্রবাহ আসে পাহাড়ের কোল থেকে। হাওরের উত্তর দিকে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে গড়িয়ে যায় বিশাল জলরাশি। আরও দূরে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরার পাহাড়। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এটি বর্ষায় প্রায় ৮০ মাইলব্যাপী বিস্তৃত হয়। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এই হাওর অবস্থিত। এর ৪০ ভাগ বড়লেখা, ৩০ ভাগ কুলাউড়া, ১৫ ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ ভাগ গোপালগঞ্জ এবং ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার থানার অন্তর্ভুক্ত। হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর। তার মাঝে বিলের আয়তন শুধু ৪,৪০০ হেক্টর। বর্ষা মৌসুমে এই হাওরকে মনে হয় দ্বিগুণ বিস্তৃত এক মহাসাগর। চারদিকের অথৈ জলরাশিই এমনটা মনে হবার কারণ। এর ঠিক বিপরীত দৃশ্য চোখে পড়ে শুষ্ক মৌসুমে। এসময় পুরো হাওরজুড়ে থাকে বিশাল ফসলের মাঠ।
হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে নানান জনশ্রুতি আছে। কথিত আছে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় লুকিয়ে পড়লে কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’ আবার এ কথাও বলা হয় যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি এক সময়ে বসবাসরত কুকি, নাগা উপজাতিরা তাদের ব্যবহৃত উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করেন হাকালুকি। যার অর্থ, লুকানো সম্পদ। হাকালুকি হাওরে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি ছোট, বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে। বর্ষার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলগুলো একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় সারা বছর এসব হাওড়ে পানি থাকলেও মাঘ ও চৈত্রে একেবারে পানি থাকে না বললেই চলে। হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলসমূহ হলোÑ চাতলা বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, হাওয়ার খাল বিল, ফুটি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, মুনসি বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, দিয়া বিল প্রভৃতি। এইসব বিলগুলোর পানির রঙ সবুজাভ ও স্বচ্ছ। হাওর থেকে পানি নামার পর কিছু জায়গায় ধানের আবাদ হয়। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলই অনাবাদি থাকে। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সবুজ সুন্দর ঘাস গজিয়ে ওঠে। ওঠে ধান। তখন আশপাশের, এমনকি দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া অবাধে মাঠে বিচরণ করে। এভাবে হাকালুকি হাওরে বহুকাল আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাথান পদ্ধতি’। হাওর উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকজন ফসল ওঠার পর বছরের নির্দিষ্ট ক’মাস বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে তাদের গবাদি পশু পাঠিয়ে দেয় হাওরে বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের কাছে। এরা গরু মহিষের তত্ত্বাবধান করে। বিনিময়ে দুধ পায়। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নিয়ে যায়। বাথানের মালিকরা এই দুধ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এ কারণে এক সময়, এমনকি এখনও হাকালুকি অঞ্চল দুধ ও দই’র জন্য প্রসিদ্ধ।
হাকালুকি হাওরের স্থায়ী জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় জলে ভাসমান বড় বড় গাছপালা এখন আর তেমন নেই। চাতলা বিলে ছোট আকারের এরকম একটি অরণ্য দেখতে পাওয়া যায়। হাওর সংলগ্ন জনসাধারণ প্রতিনিয়ত জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কেটে ফেলছে। হাওর এলাকায় জন্মানো উদ্ভিদগুলোকে এভাবে ভাগ করা যায়-
পানিতে নিমজ্জিত উদ্ভিদ: এ ধরনের উদ্ভিদ সব সময়ই পানিতে ডুবন্ত থাকে। এদের স্থানীয় নাম কুরেলি, ঝাঁঝি, জলপিপুল, শেওলাঘাস, ঘেঁচু, কেরুলী।
মুক্তভাসমান উদ্ভিদ: এরকম উদ্ভিদ মুক্তভাবে ভেসে বেড়ায়। ভেসেই খাদ্য যোগাড় করে। যেমন- কচুরিপানা, ঝাঁঝি, তেঁতুলাপানা, ইন্দুর কানিপানা।
শিকড়যুক্ত ভাসমান উদ্ভিদ: এদের শিকড় পানির নিচে মাটির গভীরে থাকে। কিন্তু পাতা ও ফুল পানির ওপরে থাকে। যেমন- সিংড়া, পানিফল, পারুয়া, ঝরা ধান, কার্পুন/অস্বুজা, শুশানি শাক, পানচুলি এবালি।
জলজ তৃণ এবং দুর্বাঘাস: ছাইরা, সানচি, পানিবেত/মুর্তা, কেবুর, ভিমরাজ, হেলেঞ্চা, হারহাচ, বড় নিবিশি, কলমিশাক, ঢোলকলমি, মলচা, পানি ডগা, কেশরদাম, কুকড়া/পানিমরিচ, বিন্না, গন্ধবেনা এই জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।
নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ: এ ধরনের উদ্ভিদ হাকালুকি হাওরের উঁচু ভূমির ঢারুতে জন্মে। যেমন- সোমলতা, শতমুলি, হিলুম, বালাডুমুর, ডুইডুমুর, ভূঁইওকরা, নলখাগড়া, খাগ, আইশ।
বিশুদ্ধ পানিতে নিমজ্জিত অরণ্য: হাওরের পানিতে ৮ থেকে ১২ মিটার উঁচু গাছগুলো ঘন সবুজ। হিজল, করঞ্জা, বরুন, ছিটকি, পিঠালী, বৈশাখী, পানি হিজল। গাছগুলো হাওড়ের সৌন্দর্য।
বসতবাড়ি সংলগ্ন উদ্ভিদ: হিজল, বাঁশ, বান্দরিবেত/ছচিবেত, ঢাউর/গোলসাগু, নারিকেল, বরুন, বট, জারুল, আম, করঞ্জা, কালজাস, পিঠালী, বরুই, কড়ই, কদম, সুপারি, কাঁঠাল, শিমুল, দেশিগাব, মান্দার, রেইন-ট্রি এই এলাকার বসতবাড়িগুলোর কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠতে দেখা যায়।
মাছের জন্য হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের অন্যতম। বড় ও উন্নত জাতের মাছের গর্ভাধার হলো এই হাওর। এখানে মাছের ডিম পাড়ার উপযুক্ত প্রায় ৫,০০০ হেক্টর এলাকা আছে। যেখানে বছরে প্রায় ২.৫০০ টন মাছ উৎপাদন হয়। হাকালুকি হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন, বারজালা বিলে প্রধানতÑ রুই, পিংলার কোণা, মালাম এবং মুছনা বিলে আইড়, বোয়াল ও পুটি; চিনাউরা বিলে বোয়াল, শিং, মাগুর ও টেংগা; কুকুরডুবি, চাতলা ও কাটুয়িা বিলে পাবদা তুরাল, রাঁচি; কুইয়াচুরি বিলে বাতাসি; বালিজুরি ও লামরা বিলে সরপুটি এবং নাদবিলে চিতলমাছের প্রাধান্য রয়েছে। তাছাড়া হাকালুকি হাওরে বড় বড় ঘাগট (আইড়), কালবাউশ, কাংলা, বাইম, ভেদা বাইল্যা, চেলা, মলা, ঢেলা, কইচা, ইচা (চিংড়ি) মাছ পাওয়া যায়। ইজারাদাররা অক্টোবর মাস থেকে বিলে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। অক্টোবর মাসে তা শেষ হয়। বন্যার ফলে উজান থেকে বিভিন্ন পুকুরের ছোট বড় সব মাছ হাওরে চলে আসে। ফেব্রুয়ারিতে বিল সেচে সব মাছ ধরা হয়। এ কারণে হাওরে আগের মতো মাছ উৎপাদন হয় না। বড় আকারের দামি মাছ আজমীরিগঞ্জ, কুলিয়ারচর, ঢাকা, চট্টগ্রামে চলে আসে। আর হাওর সংলগ্ন এলাকায় পাওয়া যায় ছোট আকারের কম দামি মাছ।
হাওরে মাছ ধরার জন্য আছে জেলে সম্প্রদায়। এদের মাঝে আবার ভাগও আছে। যেমন, পেশাদার জেলেদের প্রধান পেশাই হলো মাছ ধরা। এরা ঐতিহ্যগতভাবেই জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত। স্থানীয়ভাবে এদেরকে ফ্রিশারম্যান বা মাইমাল বলা হয়। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই এই পেশার সাথে জড়িত। হিন্দু জেলেদের বলা হয় পাঠনি। অন্যদিকে ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিরা ফসল ফলানোর নির্ধারিত সময়ের পর জেলের কাজ করে থাকেন। এরা মৌসুমি জেলে হিেেবই পরিচিত। বর্ষকালে কাজের অভাবের কারণই তাদের এ পেশায় নামার কারণ। আরেকটি বিষেশ শ্রেণীর জেলে আছে। এদেরকে বলে খোরাকি জেলে। হাওরের পাড়ের লোকজনই সাধারণত এই কাজ করে থাকে। খাদ্যের বিনিময়ে মাছ ধরার কাজ করে তারা।
হাকালুকি হাওরে মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয় বেড়াজাল, দেররা জলা, কাঠি জাল, দোরা জাল, কারেন্ট জাল, ফাঁসি জাল, ভেসাল, দিয়ল জাল, আদা ঠেলা জাল, পেলুন, ঝাঁকি জাল ইত্যাদি। হাকালুকি হাওরের অভ্যন্তরের বিলসমূহ প্রতিবছরই লিজ দেয়া হয়। ইজারাধীন জলাশয় জলমহাল বলে পরিচিত। এর মেয়াদ থাকে ১ থেকে ৩ বছর। ১৯৫০ সালে স্টেইট একুইজিশন অ্যাক্ট প্রবর্তনের ফলে মিরাশদার শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মধ্যস্থতাকারী মৎস্যজীবী শ্রেণী ক্রমশ ইজারাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ওঠে। এইসব বিলের ইজারাদাররা সাধারণত সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন।
হাওরে মাছ শিকার নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে এখানে। হাওর সংলগ্ন কানুনগো বাজারের সালেহ আহমেদ বলেন, নজরুল ইসলাম ও জীতেন্দ্র বিশ্বাসের কাছ থেকে এ নিয়ে অনেক গল্প শোনা গেল। হাওরে মাছ শিকারের ক্ষেত্রে নাকি ‘আফদা’ বলে ভৌতিক ব্যাপার আছে। এটি রাতে জেলেদের দিকভ্রান্ত করে ফেলে। ফলে জেলেরা ভোর না হওয়া পর্যন্ত নিজ ঠিকানায় পৌঁছতে পারেন না। যদি কোনো জেলে গভীর রাতে আফদ দ্বারা আক্রান্ত হন এবং ওই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে চান তাহলে তাকে বিভিন্ন অশ্লীল কাজ করতে হয়। এর মধ্যে আছে উলঙ্গ হয়ে নৌকার চারদিকে প্রস্রাব করা করা। এই ধরনের কাজ করলেই নাকি আফদ থেকে মুক্তি মিলবে। এই আফদ আবার কথাও বলতে পারে। হাওরে ‘মাছের রাখাল’ বলে একটা কথা চালু আছে। এই রাখাল লাখ লাখ মাছ নিয়ে উজান থেকে ভাটির দিকে যায়। যে বিলওয়ালার তাক্বদির ভালো থাকে তিনি ওই বছরে কোটিপতি হয়ে যান। এই রাখালের প্রমাণ হলে একটি গাছের গুড়িতে করে সে চলাফেরা করে। সেও বাংলায় কথা বলে। বর্তমানে এই হাওর বেশ সমস্যাযুক্ত। যেমন- বোরো ধান চাষের সময় সার, কীটনাশক এবং রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে কীটনাশক ওষুধ পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে মাছের অভয়াশ্রম কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখিরা আর আগের মতো আসে না। বিরল প্রজাতির প্রাণীরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। হিজল, করোচ, বরুণ ইত্যাদি গাছ কমে যাওয়ার ফলে বন্যায় পানির তরঙ্গ প্রবাহ এবং পাড় ভাঙন বেড়ে গেছে। হাওরে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকা ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত ও শব্দ দূষণ হচ্ছে। হাওর প্রসঙ্গে স্থানীয়রা বেশ কিছু দাবির কথা জানালেন, রাজস্বভিত্তিক ইরাজা প্রথা বন্ধ করা, উৎপাদনমুখী ইজারা প্রথা চালু করা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের ইজারার বিলোপ ঘটানো, বিশেষ অঞ্চলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, মৎস্য সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ আরও জোরদার করা, জলাশয় সেচে মাছ আহরণ বন্ধ করা, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ বন্ধ করা। হাকালুকির হাওর সম্ভাবনায় একটি হাওর। মাছ চাষসহ নানা পরিকল্পনা করে এই হাওরকে উন্নয়নের আওতায় আনা যায়। পর্যটন শিল্পের আওতায় যদি একে আনা যায় সরকারের লাভ ছাড়া ক্ষতি হওয়ার কোনো লক্ষণ সরেজমিন গিয়ে চোখে পড়েনি।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সোজা বড়লেখা বাসে বা ট্রেনে আসা যাবে এই হাওরে। ভাড়া ২০০ টাকা। সেখান থেকে পশ্চিমে চোখ মেললেই আপনার কাংখিত হাওর চোখে পড়বে।

Tuesday, July 17, 2012

মাধবকুণ্ডের খাসিয়া জীবন

শাহীন আহমেদ
সূর্যাস্তের আগেই মাধবকুন্ডে আঁধার নামে। জলমর্মর নৈঃশব্দের গভীরতা বাড়ায়। ভয়ের কিছু নেই। কাছেই আছে খাসিয়াদের পুঞ্জি। পানের জুমক্ষেত। পাখারিয়া পাহাড়ের বুক কেটে বাসযোগ্য করেছেন খাসিয়ারা। গড়েছেন বসতি। খাসিয়া পুঞ্জি দেখতে অপূর্ব ও নৈসর্গিক। পুঞ্জি পৌঁছুতে চোখে পড়ে ঘন অরণ্য। সবুজ পত্রপল্লবিত গাছাগাছালি। দুটি পাতা একটি কুঁড়িতে ভরা চা বাগান। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে শর্পিল পিচঢালা পথ। মাধবকু-ের চোখের জলে বয়ে যাওয়া ছড়ার (ছোট নদী) ছড়ার পাশে অভিবাসিত আদিবাসী খাসিয়াদের অবস্থান। খাসিয়া পুঞ্জিতে মন্ত্রীর অনুমতি ব্যতীত বহিরাগতদের প্রবেশ নিষেধ। প্রবেশ পথে লেখা আছে ‘কুকুর হইতে সাবধান’। আমরা বিপাকে পড়লাম। সহযোগিতা চাইলাম স্থানীয় দুজন বাঙালির। এগিয়ে এলেন লক্ষ্মীছড়া সনাতনপুর গ্রামের মাসুক আহমেদ ও আবদুল হামিদ। তাদের সহযোগিতায় আমরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি পেলাম। বসলাম মন্ত্রীর ঘরে। মন্ত্রীর গেস্টরুম মন্ত্রিত্ববিহীন। ১টা বড় টেবিল চার থেকে পাঁচটা চেয়ার ছাড়া আর কোনও আসবাবপত্র নেই। তিনি পুঞ্জিতে নেই। আছেন দূরে কোথাও। কেউ জানে না। মাসুক, হামিদ ছোটাছুটি করে ম্যানেজ করলেন বয়োবৃদ্ধ একজন খাসিয়াকে। নাম মিদরিন ছুরান। বয়স আনুমানিক ৮৫ বছর। বয়স তাকে ন্যুজ্ব করেনি। বেশ প্রাণবন্ত। তিনি এগিয়ে এলেন। বসতে দিলেন আনুমানিক ছয় ইঞ্চির ছোট পিঁড়িতে। মিদরিন বেশ হাসিখুশি, কথা বলতে পারেন ঢাকার শুদ্ধ বাংলায়। আঞ্চলিক আর নিজের ‘খাসি’ ভাষায়। বললেন- আমাদের একজন প্রধান আছেন। তাকে আমরা মন্ত্রী বলি। সবকিছুতে তার আনুগত্য করি। এই মন্ত্রী হন বংশানুক্রমে। একজন থেকে আরেকজন। মাধবকু-ে কিভাবে মানববসতি গড়ে উঠল। এ এক বিস্ময়। খাসিয়ারা জংগল পরিষ্কার করেছেন। করেছেন বাসযোগ্য, চাষযোগ্য। জানতে চাইলাম পুরনো দিনের কথা। মিদরিন ছুরানের চোখ চকচক করতে লাগল। আবেগজড়িত কণ্ঠে বললেন। এখানে এক সময় গভীর জঙ্গল থেকে হুটহাট করে বাঘ চলে আসত। সবাই মিলে বাঘ প্রতিহত করেছি। মেরেছি। আরও মেরেছি পণ্য শূকর, শৃগাল, শাপ এবং বন্য জানোয়ার। এইসব হিংস্র বন্য পশুদের হাতে তাদের অনেক মারাও গেছেন। জীবনের বলিদানে খাসিয়া জীবন এখানে থেমে থাকেনি। বরং তা আরও বেড়েছে। বর্তমানে এখানে আছে ৮৫টি খাসিয়া পরিবার। লোকসংখ্যা পাঁচশ’রও অধিক। প্রধান পেশা পান চাষ। এই পানের খ্যাতি আছে সিলেট থেকে শুরু করে বিলেত পর্যন্ত। কলাগাছ আছে অনেক। পরিচর্যা করতে হয় না। এমনিতেই অনেক। ফলে তা নিজেরা খায় এবং বিক্রিও করে। নিবু নিবু বিকেল। এই সময়ে খাসিয়ারা ব্যস্ত সময় কাটান। সবাই পান সংগ্রহে ব্যস্ত থাকেন। সাঁঝের আগেই ঘরে ফেরেন। ছেলেরা গাছ থেকে পান পাড়েন। মেয়েরা ঝুড়িতে করে তা ঘরে নিয়ে আসেন। কর্মঠ প্রায় সব খাসিয়াদের হাতে একটা করে দা থাকে। নাম টাখলি দা। মেয়েরা পানের গুছি করেন। ১২টি পানে এক গুছি। ১২ গুছিতে ১ গোটা। ২০ গোটায় ১ কুড়ি। এক কুড়ির দাম সাতশ থেকে ১ হাজার টাকা। শেষ বিকেলে মিদরিন ছুরানের সংসারের সবাই ঘরে ফিরলেন। সাথে পানের ঝুড়ি। হাতে টাখলি দা নিয়ে। চেহারায় কোনও ক্লান্তি নেই। খাসিয়া মেয়েরা খুব লাজুক। লাজ ভাঙতে একটু সময় লাগল। আমাদের আসার একে একে যোগ দিলেন সুতানা মুকসর, প্রসপার মুকসর, জনি মুকসর, পলি ও প্রীতি মুকসর। মজার বিষয় সবার নামের শেষ অংশটা মায়ের নাম।

খাসিয়া সমাজে মেয়েদের প্রাধান্য বেশি। মেয়েদের বিশেষ সম্মান ও আলাদা মর্যাদা। খাসিয়া পরিবার মাতৃতান্ত্রিক। প্রবাদ আছে লংজেইদ না কিন থেই (নারীদের হাতে মানবজাতির উৎপত্তি)। মেয়েরা ধনসম্পদের উত্তরাধিকারী। পরিবারের ছোট মেয়ের ধনসম্পদে প্রাধান্য বেশি। বংশ পরিচয় দেওয়া হয় মায়ের বংশানুক্রমে। খাসিয়া সমাজে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার সুযোগ আছে। এ জন্য বেশিরভাগ বিয়ে হয় প্রেম করে। বিয়ের ক্ষেত্রে কথাবার্তা পাকা হলে ডিম ভাঙা পদ্ধতির দ্বারা শুভ অশুভ ফলাফল নির্ধারিত হয়। বিয়ের পর পুরুষকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে হয়। স্বগোত্রে বিবাহ খাসিয়া সমাজে নিষিদ্ধ। শ্বশুরবাড়িতে পাঁচ বছর থাকার পর স্বামী স্ত্রী অন্যত্র থাকার সুযোগ পায়। বিয়ে হয় খ্রিস্টান পদ্ধতিতে। বিয়ের পর ভোজ হয়। ভোজ দেন কনের মা। এইটুকু বলে মিদরিন ছুরানের বৌ ভেতর ঘরে গেলেন। খানিকবাদে একজগ ভর্তি রঙ চা নিয়ে এলেন। শুধু মিদরিনের জন্য আলাদা বাঁশের মগ। খাসিয়াদের দেহের রঙ ফর্সা, চ্যাপ্টা নাক, ছোট চোখ উন্নত চিবুক, দাঁড়ি গোফের স্বল্পতা ইত্যাদি তাদের দৈহিক বেশিষ্ট্য। মেয়েরা দেখতে বড়ই মায়াবতী। একহারা গড়ন। øিগ্ধ, শান্ত, স্লিম। উঁচু টিলা উঠানামাই এই স্লিম দেহের মূল কারণ। খাসিয়া নারী-পুরুষ কঠোর পরিশ্রমী ও সুঠাম দেহের অধিকারী। এরা সবাই কর্মী। প্রাণবন্ত, প্রাণচঞ্চল ও স্বতঃস্ফূর্ত। খাসিয়াদের বিয়ে বা পূজা পার্বণসহ সব সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ গাচ থাকবেই। এরা সবাই ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। যিশুখ্রিস্টের জন্মতিথিতে বড় দিনে পালিত হয়। পুঞ্জিতে হয় মূল অনুষ্ঠান। আয়োজন হয় নাচ, গান আর প্রার্থনার। অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয় কা নাকড়া (ঢোল) কা মরিনাম (হারমোনিয়াম) কা দুইকারার (গিটার) কা শারতি (বাঁশি) ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র। তার খ্রিস্টধর্মাবলম্বী হলেও পূজো করেন প্রকৃতির এবং বিভিন্ন দেবদেবীর। তাদের বিশ্বাস উব্লাই নাথউ ই পৃথিবী সৃষ্টিকারী আদি দেবতা বলেলেন জনডাফরিন। পুঞ্জিতে আছে ১টি স্কুল। খাসি’ ভাষা এবং রোমান হরফে সেখানে শিক্ষাক্রম চলে। চার্চ আছে দুটি। ক্যাথলিক এবং রোমানদের আলাদা। তবে ফাদার নেই। ফাদার আসেন বড় দিনে কুলাউড়ার মিশন থেকে।
আমরা কথা বলছি মিদরিনের ঘরের দাওয়ায় বসে। এটি সমতল ভূমিথেকে আনুমানিক দুইশ ফুট ওপরে। এখানে বসে দেখা যাচ্ছে মাধবকু-ে গড়ে উঠেছে ট্যুরিজম। হোটেল-মোটেল। জায়গাটা আজকাল আর দুর্গম নয়। ঘন বন পাতলা হয়ে এসেছে। ট্যুরিস্টরা আসছেন ঝাঁকে ঝাঁকে। নানা জাতের গাড়ি হাঁকিয়ে। রীতিমত বিপ্লব। মাধবকু-ের উন্নয়ন হলেও খাসিয়া জীবনে এর কোনও প্রভাব পড়েনি।

পুঞ্জির সবকিছু ছিমছাম। সাফসুতরা। এখানে বসে মাধবকু-ের ঝর্নার জলগর্জন শুনা যায়। পুঞ্জির ঘর-বাড়ি অনেকটা ভুটানি আদলে নির্মিত। দু-একটা ঘর আছে ঐতিহ্যের স্মারক। সমতল ভূমি থেকে তিন চার হাত উপরে তৈরি, বাঁশের ঘর। আর বাদবাকি সবই ইট-পাথরের। পুঞ্জির মেয়েরা নিজেদের তৈরি পোশাক পরে। কিন্তু পুরুষরা প্যান্ট-শার্ট পরা। আধুনিক, স্মার্ট। পুঞ্জি থেকে নিচে চোখ ফেললেই বক ধড়ফড় করে ওঠে। পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে রয়ে গেছে ছোট মাধবছড়া। খাসিয়াদের বৌ-ঝিরা এখানে øান থেকে শুরু করে বাসনকুশন ধোয়ামুছা সবই করে। তবে পানি পান করেন একদম ফ্রেশ। মিনারেল ওয়াটার। এই খাবার পানি আসে মাধবকু-ের চূড়া থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে। পানি আসে সারাদিন-সারাবছর।  
গল্পের আসর সাঙ্গ করে আমরা বিদায় নেই। পাহাড়ি জনপদ ভেঙে নিচে নামি। সঙ্গে মিদরিন ছুরানের পুরো পরিবার। হাতে হ্যাজাক লাইট। এ যেন আপনজনকে বিদায় দেওয়া হচ্ছে।

কাপাসিয়ার ধাঁধার চর

শাহীন আহমেদ
গাজিপুর জেলার কাপাসিয়ার ধাঁধার চরে কেমন যেন একটা স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। হঠাৎ করে আকাশে এক ঝিলিক রোদ দেখা গেল। দুপুরের চকচক সোনা রোদ। পাশেই নদীতে থৈ থৈ জলরাশি। উপরে দিগন্ত বি¯তৃত খোলা আকাশ। মাছরাঙা পাখির হুটহাট জলচুম্বন। জলের সাদা ফেনা থেকে আছাড় খাচ্ছে ২৩৯ একর জমি নিয়ে গভীর জলের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ধাঁধার চরের বুক। দূর থেকে দেখলে এ চরটিকে অনেকটা সেইন্ট মার্টিনস-এর মত মনে হয়। ধাঁধার চরের অবস্থানটা বেশ ধাঁধা লাগানো। চরের একপাশে শীতলক্ষ্যা নদী, অপর পাশে ব্রহ্মপুত্র নদ। দুই দিকে দুই থানা কাপাসিয়া ও শিবপুর। আর আছে দুই পাশে দুই জেলা গাজীপুর ও নরসিংদী। বর্ষা মৌসুমে দুইটি নদীই থাকে গর্ভবর্তী। জলে টইটুম্বর। আর শীতকালে এটি হয়ে ওঠে আরও মনোরম, আরও মনোলোভা। তখন দুই নদীর জল শুকিয়ে হাটুজলের নিচে চলে যায়। লোকজন পায়ে হেঁটেই চরে আসতে পারে। স্থানীয় তারাগঞ্জ, লাখপুর, রাণীগঞ্জ ও চরসিন্দুর-এর মাঝখানে এ চরকে দেখলে মনে হয় ভাসমান টাইটানিক গ্রাম। ধাঁধার চর লম্বায় ৪ কিঃ মিঃ, চওড়ায় বর্ষায় আধা কিঃ মিঃ। আর শীতকালে আনুমানিক এক কিঃ মিঃ ব্যাপী বি¯তৃত। এই আলো আঁধারের জীবন নিয়ে চরবাসী আছেন হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা নিয়ে। চরের বাসিন্দা সত্তরোর্ধ রমিজ উদ্দীনের জবানীতে তা ফুটে উঠল। চরকে কেন্দ্র করে তাদের জীবন নির্বাহ হয়। আনুমানিক ২০০ বছর আগে জেগে ওঠা এই চরকে স্থানীয়রা কেউ কেউ বলেন মাঝের চর। কারণ এটি ব্রহ্মপুত্র নদ ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গম স্থলে অবস্থিত। এক সময় এই চরের নাম-নিশানা ছিল না। ছিল বহমান নদী। তারপর আস্তে আস্তে বিন্দু বিন্দু বালুকণা জমতে জমতে বেলে মাটিতে পূর্ণ হয়ে এক সময় যখন চর জেগে ওঠে, তখন স্থানীয় লোকজন এটি দেখে ধাঁধায় পড়ে যান। সেই থেকে এর নাম ধাঁধার চর।

জেগে ওঠা চরের মালিকানা নিয়ে ভাওয়ালের রাজা এবং বার ভূইয়াদের এক ভূঁইয়া মহেষ উদ্দীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। শেষে মালিকানা পেয়ে যান ভাওয়ারের রাজা। তারপর স্থানীয় হিন্দু কৃষকরা ভাওয়ালের রাজাকে খাজনা দিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। ১৮১৬-১৮১৯ সালে ব্রিটিশরা এর জরিপ করে এবং খাজনা প্রদানের মাধ্যমে হিন্দু কৃষকদের বৈধ মালিকানা প্রদান করে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগের পর সব হিন্দুরা চরের জমি স্বল্পমূল্যে বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমান। এসব না জানা তথ্য জানালেন স্থানীয় বয়োঃজ্যেষ্ঠ মুসলেহ উদ্দীন আহমদ মেম্বার। বর্তমানে পুরো চরের মালিকানা মুসলিম কৃষকদের হাতে। এদেরই একজন রমিজ উদ্দীন চরে বসতি গেড়েছেন দীর্ঘ চার যুগ আগে। তিনিই এখন চরের জীবন্ত ইতিহাস। তার জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে যথেষ্ট ঝড়-ঝাপটা। তার দু’খানি ঘরের একটির ছাদে টিনের শেড আর লেপামোছা মাটির দেয়াল। নিকানো উঠোন বেশ ফকফকা ভাব। ঘরের চারপাশ ফলফরাদিতে ভরা। টিনের চালে ধরেছে চাল কুমড়া, একপাশে ঝুলে আছে কিছু কাঁকরোল, উচ্ছে আর চিচিংগা। আরও আছে হাল চাষের বলদ, দুধের গাভী, খড়ের গাদা আর গোয়াল ঘর। আরও আছে কত নাম না জানা ফল। এ যেন এক বাগান বাড়ি। চরের মাটি খুবই উর্বর। এখানে রোপণ করলে হয় না, এমন কোন ফল বাংলাদেশে নেই। এক সময় চরে প্রচুর আখ হত। এখন সবচে’ বেশি আলুর চাষাবাদ হয়। চরের মাটির তলে বা মাটির ওপরে যা রোপণ করা হোক না কেন তা অতিফলনীশল এবং তা সারবিহীন ও সুস্বাদু। চরে আছে একটি বটবৃক্ষ। ভাওয়ালের রাজার সময় থেকে এখানে পূজা-অর্চনা শুরু হয়। এখনও কার্তিক মাসে স্থানীয় পূজারীরা এখানে আসেন। পূণ্যের আশায় করেন পুজো-তর্পন। আমরা কথা বলছিলাম রমিজ উদ্দীনের নিকানো উঠোনে বসে। তিনি আমাদের গল্পের মত শোনাচ্ছেন চরের কথা। ১৯৬০, ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যায় চর তলিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬০ সালের বন্যার পর চরে কোমর পর্যন্ত পানি জমে ওঠে। ফলে মাটির উর্বরাশক্তি আরও বাড়তে থাকে। এই চরে বিজলি নেই, টিভি নেই, এমনকি একটি রেডিও চোখে পড়ল না। শুধালাম চাচা মিয়া নামাজ পড়েন কীভাবে? বললেন ফজর, জোহর পড়ি সূর্য দেখে আর আসর, মাগরিব পড়ি ঝিঙে ফুল দেখে। যেমন ঝিঙে ফুল ফুটলে আসরের ওয়াক্ত শুরু আর ফুল চুপসে গেলে মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হয়। রমিজ উদ্দিন যখন আমাদের সঙ্গে আলাপ করছিলেন, তখন চরে অনতিদূরে তালগাছগুলো পাতা নেড়ে সন্ধ্যাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। টকটকে লাল সূর্য শীতলক্ষ্যা ও ব্রহ্মপুত্রের গভীরে রাত্রির জন্য ঘুমোতে যাচ্ছে। হয়তো গভীর রাতে নামবে আকাশ বেঙে ধবল জোছনা। সূর্য মামা সকালবেলা ঘুম থেকে চরকে নতুন জামা পরিয়ে দেবেন। উদিত সূর্যের আলোকে আলোকিত হয়ে উঠবে ধাঁধার চর। ঝিরঝিরে বাতাস। উড়ন্ত পাখির কলকাকলি। মাঝির আকুল করা গান, নদীর কূল নেই রে-চরের বুক দিয়ে হাটলে কল্পনা করা যাবে না এটি একটি চর-যার দু’পাশে রাক্ষুসে দুই নদী। মনে হবে মাসি-পিসির ঘুম পাড়ানো শান্ত-øিগ্ধ একটি গ্রাম। তবে মাঝে মাঝে চরে চুরি সংঘটিত হয়। চোররা গরু, ছাগল ও ফসল ইত্যাদি চুরি করে নিয়ে যায়। মলিন বদনে বেদনা বিধুর হয়ে রমিজ উদ্দীন আমাদের এইটুকু জানালেন। তবে চরকে নিয়ে স্থানীয়দের মাঝে বেশ উচ্ছাস লক্ষ্য করা গেল- স্থানীয় রতন, আজিজ, পুলক, সাইফুল জানালেন, শীত এবং বর্ষা মৌসুম ছাড়াও ঈদে চর বিপুল লোক সমাগম ঘটে। এছাড়া প্রায় বিকেলে এখানে অনেকে আসেন আড্ডা দিতে। আবার কেউ কেউ বন্ধু বান্ধবদের জন্মবার্ষিকীও এখানে পালন করেন। মোট কথা স্থানীয় তরুণদের আড্ডা এখানে লেগেই থাকে। ধাঁধার চর দেখতে আসেন ভ্রমণ পিপাসুরা দূর-দূরান্ত থেকে। এই চরকে যদি পর্যটন করপোরেশনের আওতায় আনা হয়, তাহলে পর্যটকরা এটি দেখে মুগ্ধ হবেন। আর সরকারের তহবিলে জমা পড়বে বিপুল পরিমাণে কাগজী মুদ্রা। সত্যিকার অর্থই এটি দেখার মত একটা জায়গা। যেভাবে আসা যাবে-ঢাকার গুলিস্তান বা ফার্মগেট থেকে কাপাসিয়া আসবেন। ভাড়া লাগবে মাত্র ১০০টাকা। এখান থেকে সোজা তারাগঞ্জ চলে এলেই দেখা যাবে দুই নদীর বুকে ভাসছে অদ্ভুত ধাঁধা লাগানো একটি চর। এরই নাম ধাঁধার চর। ছবি:মোস্তাফিজ মামুন