Friday, July 27, 2012

সিলেটের সাঁওতাল



শাহীন আহমেদ
বড়লেখার অরণ্যশোভিত পাহাড়ি এলাকায় সবুজ চা বাগানের মাঝে এক বুক কষ্ট নিয়ে কোনভাবে বেঁচে আছে সাঁওতাল সম্প্রদায়। ‘গাছ ছিলালে রুপিয়া মেলে’ এই লোভ দেখিয়ে বৃটিশরা ভারতের উড়িষ্যা থেকে এদের নিয়ে আসে। দু’শো বছরেরও বেশি সময় আগে আসা সাঁওতাল জনগোষ্ঠী সিলেটের লাল মাটি আঁকড়ে পড়ে আছে আজও। চা শ্রমিকের পোশাকে এখন তারা অন্তর্ভূক্ত হয়েছে বাংলাদেশি হিসেবে। এতটুকুই তাদের উত্তোরণ। কিন্তু তাদের জীবনকাঠামোর কোন উন্নয়ন ঘটেনি। মানবেতর জীবন যাপন পিছু ছাড়ে না তাদের। এদেরকে কুলি বা লেবার বলেই সম্বোধন করা হয়। পাথারিয়া সাঁওতাল পল্লীতে প্রবেশের পর বেশ বিপাকে পড়া গেল। এরা কেউ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে বা তাদের ঐতিহ্যবাহী তীর ধনুকের ছবি ওঠাতে দিতে আগ্রহী নয়। স্থানীয় ফখরুল ইসলাম সোহাগ একজন বয়োবৃদ্ধ ভদ্রমহিলার কাছে আমাদের নিয়ে গেলেন। তিনি সাঁওতালদের কাছে ‘বড় মা’ বলে বিশেষ পরিচিত। সাঁওতাল পল্লীতে তার প্রতাপ চোখে পড়ার মতো। চা শ্রমিকদের বউরা গর্ভবতী হলে তিনি একজন ‘দাইমা’ হিসেবে কাজ করে থাকেন। তাই তার এত কদর। ‘বড় মা’ ছোট বাঁশেখর লাঠিতে ভর করে শুক্রাম বলে হাক দিতেই সাঁওতাল পল্লীর ছোট বড় সবার মাঝে সাড়া পড়ে গেল। শুক্রাম হন্তদন্ত হয়ে আমাদের বসার ব্যবস্থা করতে লাগল। কাঁচা সুপারি আর পান দেওয়া হলো আমাদের। জমে উঠল গল্পের আসর। বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মত সাঁওতালদেরও রয়েছে বৈচিত্রময় জীবনযাত্রা, কৃষ্টি ও সংস্কৃতির ধারা। এদেশে অধিকাংশ সাঁওতালদের বচবাস রাজশাহী ও দিনাজপুর জেলাতে হলেও দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতেও ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে এদের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। নৃতাত্বিক বিশ্লেষণে সাঁওতালদের আদি অস্ট্রেলীয় পরিবারের অন্তর্ভূক্ত একটি বংশ বলে জানা যায়। সিলেটের সাঁওতালরা ভারতের নাগপুর ও সাঁওতাল পরগনা থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে বলে জানা যায়। কর্মঠ দেহের অধিকারী সাঁওতালদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এছাড়াও সাঁওতালদের পালিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুটে উঠতে দেখা যায় সভ্যতার আদি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। সাঁওতালদের ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে রয়েছে প্রকৃতি পূজার বৈশিষ্ট্য। সাঁওতালদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাস আছে কিন্তু কোনও ধর্মগ্রন্থ নেই। ভাষা আছে কিন্তু বর্ণ নেই। তারপরেও এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের জীবন জীবিকায় কোন শঠতা, মিথ্যাচার নেই বললেই চলে। আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চোখে পড়ে। সমাজ ঘটিত যে কোনও অন্যায় অপরাধের বিচার তারা সামাজিকভাবেই সমাজ প্রধানের দ্বারা নিষ্পত্তি করে থাকে। তাদের সামাজিক ব্যবস্থায় গ্রাম পঞ্চায়েত প্রাধান্য পায়। বিচার ব্যবস্থার প্রথম স্থরে রয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। যার সদস্য সংখ্যা ৫। এরা হলো- মাঝিহাড়াম, জগমাঝি, পরাণিক; গোডেৎ ও নায়েকে। নায়েকেকে তারা সাধারণ পঞ্চায়েতের সদস্য নয় বলে শুধু ধর্ম গুরু বা পুরোহিত হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। সাঁওতালরা পিতৃপ্রধান পরিবারের লোক। তাদের সমাজে পিতার সূত্র ধরে সন্তানের দল ও গোত্র (বংশ) পরিচয় নির্ণয় করা হয়। এ অঞ্চলে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে সমৃদ্ধি সংস্কৃতি সত্ত্বা লক্ষ্য করা যায়। এদেশে বসবাসরত অন্যান্য আদিবাসী সম্প্রদায়ের মতো সাঁওতালদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বনসহ সব উৎসবেই নৃত্যগীত একটি অপরিহার্য অংশ। বিশেষ করে জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, পূজা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে নানা লোকাচার সংস্কার দেখা যায়। সাঁওতাল সমাজেও রয়েছে গোত্রপ্রথা। স্বগোত্র বিবাহ এদের সমাজে নিষিদ্ধ। আর এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে কোনও ছেলে মেয়ে যদি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, তবে সমাজ তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করে। সাঁওতালদের রয়েছে বারটি গোত্র। যেমন- হাসদা, কিস্কু, মুর্মু, হেমব্রম, মার-ি, সোরের, টুভু, বাস্কি, গোয়া সোরেন, বেসরা, পাউরিয়া ও চোঁডে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ে বিবাহ প্রথা চার ধরনের। ডাঙ্গুরা বাপ্পা বা আনুষ্ঠানিক বিয়ে, অঙ্গির বা প্রেমঘটিত বিয়ে, অ-র বা বলপূর্বক বিয়ে, ইতু বা কৌশলগত বিয়ে। উল্লেখিত সকল বিবাহেই আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে রয়েছে বাদ্য ও নৃত্য গীতের আয়োজন। এদের প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানে নেশাজাতীয় পানীয় মদ বা হাড়িয়া পান প্রচলিত। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হচ্ছে তাদের লোক সঙ্গীত। সঙ্গীতের সাবলীল সুরের মুর্ছনা ও নৃত্য ভঙ্গিমা মোহনীয় পরিবেশ এনে দেয়। সুঠাম ও কর্মঠ দেহের অধিকারী সাঁওতালদের রয়েছে নিজস্ব ভাষা। এছাড়াও সাঁওতালদের পালিত বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুটে উঠতে দেখা যায় সভ্যতার আদি সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের বিশ্বাস, মারাং বুরু দেবতাই তাদের প্রধান দেবতা। এই বিশ্ব চরাচর সৃষ্টি করেছেন তিনি। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের পার্বনিক উৎসব অনুষ্ঠান একেক এলাকায় একেক নামে অভিহিত হলেও তাদের সম্প্রদায়গত বিভিন্ন অনুষ্ঠান, উপাচার রয়েছে। যেমন, চৈত্র মাসে পালিত হয় বোঙ্গাবুঙ্গি, বৈশাখ মাসে হোম, জৈষ্ঠ মাসে এরোরা, আষাঢ় মাসে হাড়িয়া, ভাদ্র মাসে ছাতা, আশ্বিন মাসে দিবি, কার্তিক মাসে নওয়াই এবং পৌষ মাসে উদযাপিত হয় সোহরাই উৎসব। সাঁওতাল সম্প্রদায়ের অনেকেই খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী। তবে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিতে এদেশের বাঙালি হিন্দু সংস্কৃতির প্রভাব কিছুটা হলেও পড়েছে। তাইতো হিন্দুদের দুর্গাপূজা, কালীপূজা, মনসা পূজা, শিব পূজা পালন করতে দেখা যায় তাদের। আর এভাবেই আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি রূপরেখা হয়ে ওঠেছে অনেকটা মিশ্র চেহারার সংস্কৃতি। এই সম্প্রদায়ের প্রবল জাত্যাভিমান রয়েছে। কিন্তু দারিদ্র ও শিক্ষার অভাবে এদের সামাজিক সংস্কারগুলো আবদ্ধ। বান, টোনা, ডাইনী সাধন ইত্যাদি সংস্কারের কারণে তাদের মধ্যে প্রায়ই পারিবারিক কলহ ও ঝগড়া বিবাদ ঘটতে দেখা যায়। সাঁওতালরা বিয়ের সময় নানা ধরনের সামজিকতা ও আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এতে বর ও কনের পিতামাতার ভূমিকার সঙ্গে তাদের গ্রামের প্রধান মাঝিহাড়ামদেরও বিশেষ ভূমিকা থাকে। আনুষ্ঠানিক বিয়েতে ঘটকালি করার জন্য ‘রায়বারি’ ও নিযুক্ত হয়। বরের বড় ভাই অথবা স্থানীয় কোন ব্যক্তি কনেকে দেউড়ির মধ্যে বসিয়ে দেয়। তারপর সাতজন পুরুষ সেটি কাঁধে করে বিবাহ মন্ডপে প্রবশে করে। অপর দিকে বরের ভগ্নিপতি অথবা এ সম্পর্কিত কোনও ব্যক্তি বরকে কাঁধে করে বিবাহ মন্ডপে আসে। কনের পিতা ঘটে রাখা পানি বরের মাথায় ছিটিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ জ্ঞাপন করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বিয়ের মূল অনুষ্ঠান। বড় ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল দিয়ে কনের গালে পরপর তিনবার সিঁদুর লাগিয়ে দেয়। শেষে সিঁদুর পাতের সব সিঁদুর নিয়ে বর বধূর গালে লেপন করে দিয়ে সিঁদুরের পাতাটি তার পিতার হাতে ফিরিয়ে দেয়। এই অনুষ্ঠানের পর বর, বধূকে কোলে করে দেউড়ি থেকে মাটিতে নামায়। এই সময় কেন পক্ষের লোকেরা বর বধূর কাপড়ের আঁচল বেঁধে দেয়। এরপর চলে মদ্যপান ও আমোদ প্রমোদ। সাঁওতাল যুবকদের নেশা শিকার করা। নিজস্ব তীর ধনুক দিয়ে শেয়াল, বিড়াল, কাঠ বিড়ালী যা পায় তাই শিকার করে। ‘কুচিয়া’ নামক এক প্রকার মাছ শিকারে এরা খুব ওস্তাদ। সাঁওতাল নারীদের চেহারা মলিন হলেও মনের দিক থেকে এরা খুবই উদার। যে কোন উৎসব অনুষ্ঠানে খোপায় ফুল সাঁওতাল মেয়েদের চেহারায় আনে বাড়তি সৌন্দর্য।
১৯২১ সালে অত্যাচারে জর্জরিত সাঁওতালরা একযোগে এ দেশ ছেড়ে ট্রেনে চেপে নিজ মুলুকের পথে রওয়ানা হয়। চাঁদপুর থেকে জাহাজে ওঠার চেষ্টারত সাঁওতালদের ওপর পুলিশী হামলা চালিয়ে স্থব্ধ করে দেওয়া হয় সে আন্দোলন। এজন্য চা শ্রমিকদের এই আন্দোলনকে বলা হয় ‘মুলুকি’ আন্দোলন। বৃটিশরা এদের শিক্ষার সুযোগ করে দেয়নি। বাঙালি চা বাগানের মালিকরাও এদের সঙ্গে একই নিষ্ঠুর আচরণ করছেন। নামমাত্র মূল্যের বেতনে এরা অনাহারে, কখনো অর্ধাহারে জীবন কাটাচ্ছে। অপুষ্টি ও চর্মরোগসহ নানা রোগে এরা ভুগছে হরহামেশা। এদের ছেলেমেয়েরা দু’একজন স্কুল কলেজে পড়লেও বেশির ভাগই থাকছে শিক্ষাবঞ্চিত। সরেজমিন গিয়ে দেখা গেল, এরা আর স্বাভাবিক মানব সমাজে নেই। এদের জন্য বোধহয় বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে।

No comments:

Post a Comment