শাহীন আহমেদ
এক শীতের সকালে আমরা ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাই। সেখান থেকে জকিগঞ্জের বাসে শাহবাগ নামি। তারপর টেম্পোতে সোজা
কানাইঘাট বাজার। সামনেই সুরূপা সুরমা নদী। তার রূপ দেখে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। দিনটি ছিল হাটবার। নৌকায় সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা
এসেছে। নদী পাড়ে তাই নৌকার সমাবেশ। সুরমা নদীর পলিসমৃদ্ধ কানাইঘাট রবিশস্যের জন্য বিখ্যাত। শাকসবজি, তাজামাছ, মনোহারী আরও সব পসরায় বাজার জমজমাট। আমরা কচি শসা কিনি। মজা করে খাই। তারপর সঙ্গী সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে নিয়ে
মুলাগুল যাওয়ার জন্য ঘাটে যাই। হোঁচট খাই শুরুতেই। মুলাগুলের দিকে আজ আর কোনো যাত্রীবাহী নৌকা যাবে না। অনেক বলে কয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমরা একটা নৌকা ভাড়া নিই। মাঝির কাজ আমাদের শুধু পৌঁছে দেয়া। ফিরতে হবে নিজেদের
মতো।
সরু বার্কির চেয়ে একটু বড় নৌকা। দু’জন মাঝি। আমাদের যাত্রা শুরু হয়। চলছি তো চলছি। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গোঁড়ালি। লগি-বৈঠায় ভর দিয়ে নৌকা এগিয়ে যায় সামনের দিকে। নদীর দুই তীরে আদিগন্ত ফসলের মাঠ। নাইতে নামা নারী-পুরুষে,
বৌ-ঝিদের কলসিতে জল ভরায় আর শিশুদের দূরন্ত উল্লাসে মেতেছে সুরমা।
অল্প পানির কারণে মাঝে মাঝে আমরা নেমে পড়ি। মাঝিদের সঙ্গে ধাক্কায় শরীক হয়ে নৌকা সামনের দিকে নিয়ে যাই। এভাবে একসময় সুরমা নদী ডানে রেখে লোভাছড়া নদীতে গিয়ে পড়ে নৌকা। এ নদীতে জলের ছড়াছড়ি, স্রোতস্বিনী। সুরমা নদী ছুটে চলে
লোভাছড়ার পানিতে। এখান থেকে আর কিছু দূর এগোলেই সুরমার জন্মস্থান। আসাম থেকে আসা বরাক নদী দু’ভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা
নাম নিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরে। লোভাছড়া খাড়া পাহাড়ি
নদী। উল্টোস্রোত ঠেলে এগোতে থাকে আমাদের নৌকা।
মুলাগুলায় যখন নামি তখন সূর্য মাথার ওপর। ভাড়া মিটিয়ে খানিক এগোতেই বাজার। খবার হোটেলে গিয়ে দেশি
মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত খাই পেট ভরে। চা-পানের পর কাঁচা
সুপারি ও ইন্ডিয়ান বত্রিশ জর্দা দিয়ে খাসিয়া পান চিবোতে চিবোতে বাজারের অন্যদিকে হেঁটে
গিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চা বাগানের দিকে এগোতে থাকি। এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াই। আকাশ ছোঁয়া খাসিয়া-জৈন্তিয়া
পাহাড় আমাদের পথ আটকে দাঁড়ায়। একপাশে নদী আরেকপাশে
পাহাড়। মাঝখানে সবুজ ঘাস বিছানো এক চিলতে জায়গা। আমরা বসে পড়ি। গড়াগড়ি যাই। অনাবিল, অদেখা, অপূর্ব এক পৃথিবী আমাদের মনে জড়িয়ে থাকে, চোখ ভরিয়ে রাখে। ভারত এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। আমরা পা বাড়াই। পথে পাই বিডিআর ক্যাম্প। তারপরই গাঢ় সবুজমাখা মায়াময় চা বাগান।
একসময় এ চা বাগানের পথ সোজা চলে গিয়েছিল পাহাড়
পেরিয়ে আসামে। একটি পুরানো কালভার্ট এখনও তার সাক্ষী হয়ে
আছে। প্রথম দেখাতেই চা বাগানটিকে আলাদা মনে হয়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু বয়স্ক গাছ। এলাকাটি খুবই নির্জন। পথ ধরে হাঁটতেই বামে সুন্দর ডাকবাংলো। ডানে ঝাঁকড়াচুলের বিশাল
শতায়ু বটবৃক্ষ।
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। চা শ্রমিকরা ফিরতে শুরু করেছে ঘরে। চারদিকে ঘন অন্ধকার
ক্রমশ জমাট বাঁধছে। চা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠেছে কেরোসিনের
আলো। আরেকটু সামনে এগোতেই চোখে
পড়ে চা শ্রমিকদের গানের তালে তালে নাচ। আমরা দাঁড়িয়ে যাই। ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলেও তাল ধরতে পারি। এখনও কানে বাজেÑ “আবেন ডোনা ঝুরি ঝুরি...”। অন্ধকারের মধ্যে একদল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে মনের আনন্দে গান গাইছে... নাচছে.. কেমন
ছবির মতো! শ্রমিকরা এইসময়ে আমাদের দেখে বিস্মিত হয়। আমরা কোথায় থাকব জানতে চায়। আমরা আজই ফিরে যাওয়ার
কথা বলি।
আমাদের সঙ্গে তারাও আমাদের ফেরা নিয়ে ভাবতে
থাকে। কারণ চা বাগানের এ রাস্তা দিয়ে যাত্রিবাহী গাড়ি চলে না। এ সময় যাওয়ার জন্য সাধারণত কোনো যানবাহন পাওয়া যায় না। ভেবেচিন্তে তারা বলে, ঘাবড়াবেন না,
পাথর কোয়ারির শেষ ট্রাক এখনও যায়নি। ভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যাবেন। না পেলে আমরা তো আছি,
আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন। তাদের দরদ দেখে ভালো লাগে। টেনশান ঝেড়ে ফেলে আমরাও
তাদের নাচতে থাকি।
হঠাৎ করেই দূরে বিড়ালের চোখের মতো লাইট জ্বালিয়ে
কিছু একটা আসতে দেখা যায়। আমরা বুঝতে পারি এটাই
সেই পাথরবাহী ট্রাক। চা শ্রমিকরা আমাদের গাড়িতে তুলে দেন। রাতের অন্ধকারে চলতে চলতে গাড়ির আলোতে বড় বড় গাছওলা চা বাগানটি ফিরে ফিরে দেখি। পথটি ছিল গা ছমছম করা রোমাঞ্চকর। চারদিকে কোনো মনুষ্য
বসতি নেই। শুধুই টিলা আর বন-জঙ্গল। একসময় রাস্তা ছেড়ে ধানি জমির মাঝখান দিয়ে ট্রাক ছোটে। আমরা পৌঁছে যাই কানাইঘাট বাজারে।
No comments:
Post a Comment