Saturday, July 28, 2012

মুলাগুল চা বাগান



শাহীন আহমেদ
 এক শীতের সকালে আমরা ঢাকা থেকে সিলেট পৌঁছাইসেখান থেকে জকিগঞ্জের বাসে শাহবাগ নামিতারপর টেম্পোতে সোজা কানাইঘাট বাজারসামনেই সুরূপা সুরমা নদীতার রূপ দেখে পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলদিনটি ছিল হাটবারনৌকায় সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে ক্রেতা-বিক্রেতা এসেছেনদী পাড়ে তাই নৌকার সমাবেশসুরমা নদীর পলিসমৃদ্ধ কানাইঘাট রবিশস্যের জন্য বিখ্যাতশাকসবজি, তাজামাছ, মনোহারী আরও সব পসরায় বাজার জমজমাটআমরা কচি শসা কিনিমজা করে খাইতারপর সঙ্গী সাংবাদিক মিজানুর রহমানকে নিয়ে মুলাগুল যাওয়ার জন্য ঘাটে যাইহোঁচট খাই শুরুতেইমুলাগুলের দিকে আজ আর কোনো যাত্রীবাহী নৌকা যাবে নাঅনেক বলে কয়ে বেশি টাকা দিয়ে আমরা একটা নৌকা ভাড়া নিইমাঝির কাজ আমাদের শুধু পৌঁছে দেয়াফিরতে হবে নিজেদের মতো
সরু বার্কির চেয়ে একটু বড় নৌকাদুজন মাঝিআমাদের যাত্রা শুরু হয়চলছি তো চলছিকোথাও হাঁটুপানি, কোথাও গোঁড়ালিলগি-বৈঠায় ভর দিয়ে নৌকা এগিয়ে যায় সামনের দিকেনদীর দুই তীরে আদিগন্ত ফসলের মাঠনাইতে নামা নারী-পুরুষে, বৌ-ঝিদের কলসিতে জল ভরায় আর শিশুদের দূরন্ত উল্লাসে মেতেছে সুরমা
অল্প পানির কারণে মাঝে মাঝে আমরা নেমে পড়িমাঝিদের সঙ্গে ধাক্কায় শরীক হয়ে নৌকা সামনের দিকে নিয়ে যাইএভাবে একসময় সুরমা নদী ডানে রেখে লোভাছড়া নদীতে গিয়ে পড়ে নৌকাএ নদীতে জলের ছড়াছড়ি, স্রোতস্বিনী  সুরমা নদী ছুটে চলে লোভাছড়ার পানিতেএখান থেকে আর কিছু দূর এগোলেই সুরমার জন্মস্থানআসাম থেকে আসা বরাক নদী দুভাগ হয়ে সুরমা ও কুশিয়ারা নাম নিয়ে মিশেছে হাকালুকি হাওরেলোভাছড়া খাড়া পাহাড়ি নদীউল্টোস্রোত ঠেলে এগোতে থাকে আমাদের নৌকা
মুলাগুলায় যখন নামি তখন সূর্য মাথার ওপরভাড়া মিটিয়ে খানিক এগোতেই বাজারখবার হোটেলে গিয়ে দেশি মুরগির মাংস দিয়ে গরম ভাত খাই পেট ভরেচা-পানের পর কাঁচা সুপারি ও ইন্ডিয়ান বত্রিশ জর্দা দিয়ে খাসিয়া পান চিবোতে চিবোতে বাজারের অন্যদিকে হেঁটে গিয়ে গ্রামের মেঠোপথ ধরে চা বাগানের দিকে এগোতে থাকিএক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াইআকাশ ছোঁয়া খাসিয়া-জৈন্তিয়া পাহাড় আমাদের পথ আটকে দাঁড়ায়একপাশে নদী আরেকপাশে পাহাড়মাঝখানে সবুজ ঘাস বিছানো এক চিলতে জায়গাআমরা বসে পড়িগড়াগড়ি যাইঅনাবিল, অদেখা, অপূর্ব এক পৃথিবী আমাদের মনে জড়িয়ে থাকে, চোখ ভরিয়ে রাখেভারত এখান থেকে দশ মিনিটের পথআমরা পা বাড়াইপথে পাই বিডিআর ক্যাম্পতারপরই গাঢ় সবুজমাখা মায়াময় চা বাগান
একসময় এ চা বাগানের পথ সোজা চলে গিয়েছিল পাহাড় পেরিয়ে আসামেএকটি পুরানো কালভার্ট এখনও তার সাক্ষী হয়ে আছেপ্রথম দেখাতেই চা বাগানটিকে আলাদা মনে হয়ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু বয়স্ক গাছএলাকাটি খুবই নির্জনপথ ধরে হাঁটতেই বামে সুন্দর ডাকবাংলোডানে ঝাঁকড়াচুলের বিশাল শতায়ু বটবৃক্ষ
এরই মধ্যে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছেচা শ্রমিকরা ফিরতে শুরু করেছে ঘরেচারদিকে ঘন অন্ধকার ক্রমশ জমাট বাঁধছেচা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে জ্বলে উঠেছে কেরোসিনের আলোআরেকটু সামনে এগোতেই চোখে  পড়ে চা শ্রমিকদের গানের তালে তালে নাচআমরা দাঁড়িয়ে যাইভাষা বুঝতে অসুবিধা হলেও তাল ধরতে পারিএখনও কানে বাজেÑ “আবেন ডোনা ঝুরি ঝুরি...অন্ধকারের মধ্যে একদল মানুষ আগুন জ্বালিয়ে মনের আনন্দে গান গাইছে... নাচছে.. কেমন ছবির মতো! শ্রমিকরা এইসময়ে আমাদের দেখে বিস্মিত হয়আমরা কোথায় থাকব জানতে চায়আমরা আজই ফিরে যাওয়ার কথা বলি
আমাদের সঙ্গে তারাও আমাদের ফেরা নিয়ে ভাবতে থাকেকারণ চা বাগানের এ রাস্তা দিয়ে যাত্রিবাহী গাড়ি চলে নাএ সময় যাওয়ার জন্য সাধারণত কোনো যানবাহন পাওয়া যায় নাভেবেচিন্তে তারা বলে, ঘাবড়াবেন না, পাথর কোয়ারির শেষ ট্রাক এখনও যায়নিভাগ্য ভালো থাকলে পেয়ে যাবেননা পেলে আমরা তো আছি, আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেনতাদের দরদ দেখে ভালো লাগেটেনশান ঝেড়ে ফেলে আমরাও তাদের নাচতে থাকি
হঠাৎ করেই দূরে বিড়ালের চোখের মতো লাইট জ্বালিয়ে কিছু একটা আসতে দেখা যায়আমরা বুঝতে পারি এটাই সেই পাথরবাহী ট্রাকচা শ্রমিকরা আমাদের গাড়িতে তুলে দেনরাতের অন্ধকারে চলতে চলতে গাড়ির আলোতে বড় বড় গাছওলা চা বাগানটি ফিরে ফিরে দেখিপথটি ছিল গা ছমছম করা রোমাঞ্চকরচারদিকে কোনো মনুষ্য বসতি নেইশুধুই টিলা আর বন-জঙ্গলএকসময় রাস্তা ছেড়ে ধানি জমির মাঝখান দিয়ে ট্রাক ছোটেআমরা পৌঁছে যাই কানাইঘাট বাজারে


No comments:

Post a Comment