Wednesday, July 18, 2012

হাকালুকি হাওর কখনও সাগর কখনও ধু ধু মাঠ...


শাহীন আহমেদ

হাকালুকি হাওর। পূর্বে পাথারিয়া পাহাড় এবং পশ্চিমে ভাটেরা পাহাড়ের মধ্যবর্তী স্থানে বিশাল নিম্নাঞ্চল জুড়ে এই হাওরের ভৌগলিক অবস্থান। জুরি আর পানাই এই দুই নদীতে পানির প্রবাহ আসে পাহাড়ের কোল থেকে। হাওরের উত্তর দিকে প্রবাহিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে গড়িয়ে যায় বিশাল জলরাশি। আরও দূরে চোখ মেলে তাকালে দেখা যায় ভারতের মেঘালয় ও ত্রিপুরার পাহাড়। হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলায় অবস্থিত। এটি বর্ষায় প্রায় ৮০ মাইলব্যাপী বিস্তৃত হয়। সিলেট শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে এবং মৌলভীবাজার জেলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে এই হাওর অবস্থিত। এর ৪০ ভাগ বড়লেখা, ৩০ ভাগ কুলাউড়া, ১৫ ভাগ ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০ ভাগ গোপালগঞ্জ এবং ৫ ভাগ বিয়ানীবাজার থানার অন্তর্ভুক্ত। হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮,১১৫ হেক্টর। তার মাঝে বিলের আয়তন শুধু ৪,৪০০ হেক্টর। বর্ষা মৌসুমে এই হাওরকে মনে হয় দ্বিগুণ বিস্তৃত এক মহাসাগর। চারদিকের অথৈ জলরাশিই এমনটা মনে হবার কারণ। এর ঠিক বিপরীত দৃশ্য চোখে পড়ে শুষ্ক মৌসুমে। এসময় পুরো হাওরজুড়ে থাকে বিশাল ফসলের মাঠ।
হাকালুকি হাওরের নামকরণ নিয়ে নানান জনশ্রুতি আছে। কথিত আছে, বহু বছর আগে ত্রিপুরার মহারাজা ওমর মানিক্যের সেনাবাহিনীর ভয়ে বড়লেখার কুকি দলপতি হাঙ্গর সিং জঙ্গলপূর্ণ ও কর্দমাক্ত এক বিস্তীর্ণ এলাকায় লুকিয়ে পড়লে কালক্রমে ওই এলাকার নাম হয় ‘হাঙ্গর লুকি বা হাকালুকি’ আবার এ কথাও বলা হয় যে, হাকালুকি হাওরের কাছাকাছি এক সময়ে বসবাসরত কুকি, নাগা উপজাতিরা তাদের ব্যবহৃত উপজাতীয় ভাষায় এই হাওরের নামকরণ করেন হাকালুকি। যার অর্থ, লুকানো সম্পদ। হাকালুকি হাওরে প্রায় ৮০ থেকে ৯০টি ছোট, বড় ও মাঝারি বিল রয়েছে। বর্ষার পানি কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিলগুলো একটি থেকে অন্যটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। প্রায় সারা বছর এসব হাওড়ে পানি থাকলেও মাঘ ও চৈত্রে একেবারে পানি থাকে না বললেই চলে। হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলসমূহ হলোÑ চাতলা বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, হাওয়ার খাল বিল, ফুটি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, মুনসি বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, দিয়া বিল প্রভৃতি। এইসব বিলগুলোর পানির রঙ সবুজাভ ও স্বচ্ছ। হাওর থেকে পানি নামার পর কিছু জায়গায় ধানের আবাদ হয়। তবে বেশিরভাগ অঞ্চলই অনাবাদি থাকে। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সবুজ সুন্দর ঘাস গজিয়ে ওঠে। ওঠে ধান। তখন আশপাশের, এমনকি দূরবর্তী অঞ্চল থেকে আসা গরু-মহিষ, ছাগল, ভেড়া অবাধে মাঠে বিচরণ করে। এভাবে হাকালুকি হাওরে বহুকাল আগে প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাথান পদ্ধতি’। হাওর উপকূলবর্তী অঞ্চলের লোকজন ফসল ওঠার পর বছরের নির্দিষ্ট ক’মাস বিশেষ করে শুকনো মৌসুমে তাদের গবাদি পশু পাঠিয়ে দেয় হাওরে বসবাসরত একশ্রেণীর মানুষের কাছে। এরা গরু মহিষের তত্ত্বাবধান করে। বিনিময়ে দুধ পায়। মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে প্রকৃত মালিক এসে গরু-বাছুর ফেরত নিয়ে যায়। বাথানের মালিকরা এই দুধ বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এ কারণে এক সময়, এমনকি এখনও হাকালুকি অঞ্চল দুধ ও দই’র জন্য প্রসিদ্ধ।
হাকালুকি হাওরের স্থায়ী জলাশয়গুলোতে বিভিন্ন জাতের উদ্ভিদ দেখতে পাওয়া যায়। এক সময়ের অন্যতম আকর্ষণীয় জলে ভাসমান বড় বড় গাছপালা এখন আর তেমন নেই। চাতলা বিলে ছোট আকারের এরকম একটি অরণ্য দেখতে পাওয়া যায়। হাওর সংলগ্ন জনসাধারণ প্রতিনিয়ত জ্বালানি কাঠের জন্য গাছ কেটে ফেলছে। হাওর এলাকায় জন্মানো উদ্ভিদগুলোকে এভাবে ভাগ করা যায়-
পানিতে নিমজ্জিত উদ্ভিদ: এ ধরনের উদ্ভিদ সব সময়ই পানিতে ডুবন্ত থাকে। এদের স্থানীয় নাম কুরেলি, ঝাঁঝি, জলপিপুল, শেওলাঘাস, ঘেঁচু, কেরুলী।
মুক্তভাসমান উদ্ভিদ: এরকম উদ্ভিদ মুক্তভাবে ভেসে বেড়ায়। ভেসেই খাদ্য যোগাড় করে। যেমন- কচুরিপানা, ঝাঁঝি, তেঁতুলাপানা, ইন্দুর কানিপানা।
শিকড়যুক্ত ভাসমান উদ্ভিদ: এদের শিকড় পানির নিচে মাটির গভীরে থাকে। কিন্তু পাতা ও ফুল পানির ওপরে থাকে। যেমন- সিংড়া, পানিফল, পারুয়া, ঝরা ধান, কার্পুন/অস্বুজা, শুশানি শাক, পানচুলি এবালি।
জলজ তৃণ এবং দুর্বাঘাস: ছাইরা, সানচি, পানিবেত/মুর্তা, কেবুর, ভিমরাজ, হেলেঞ্চা, হারহাচ, বড় নিবিশি, কলমিশাক, ঢোলকলমি, মলচা, পানি ডগা, কেশরদাম, কুকড়া/পানিমরিচ, বিন্না, গন্ধবেনা এই জাতীয় জলজ উদ্ভিদ।
নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ: এ ধরনের উদ্ভিদ হাকালুকি হাওরের উঁচু ভূমির ঢারুতে জন্মে। যেমন- সোমলতা, শতমুলি, হিলুম, বালাডুমুর, ডুইডুমুর, ভূঁইওকরা, নলখাগড়া, খাগ, আইশ।
বিশুদ্ধ পানিতে নিমজ্জিত অরণ্য: হাওরের পানিতে ৮ থেকে ১২ মিটার উঁচু গাছগুলো ঘন সবুজ। হিজল, করঞ্জা, বরুন, ছিটকি, পিঠালী, বৈশাখী, পানি হিজল। গাছগুলো হাওড়ের সৌন্দর্য।
বসতবাড়ি সংলগ্ন উদ্ভিদ: হিজল, বাঁশ, বান্দরিবেত/ছচিবেত, ঢাউর/গোলসাগু, নারিকেল, বরুন, বট, জারুল, আম, করঞ্জা, কালজাস, পিঠালী, বরুই, কড়ই, কদম, সুপারি, কাঁঠাল, শিমুল, দেশিগাব, মান্দার, রেইন-ট্রি এই এলাকার বসতবাড়িগুলোর কোল ঘেঁষে বেড়ে উঠতে দেখা যায়।
মাছের জন্য হাকালুকি হাওর বাংলাদেশের অন্যতম। বড় ও উন্নত জাতের মাছের গর্ভাধার হলো এই হাওর। এখানে মাছের ডিম পাড়ার উপযুক্ত প্রায় ৫,০০০ হেক্টর এলাকা আছে। যেখানে বছরে প্রায় ২.৫০০ টন মাছ উৎপাদন হয়। হাকালুকি হাওরের উল্লেখযোগ্য বিলগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যেমন, বারজালা বিলে প্রধানতÑ রুই, পিংলার কোণা, মালাম এবং মুছনা বিলে আইড়, বোয়াল ও পুটি; চিনাউরা বিলে বোয়াল, শিং, মাগুর ও টেংগা; কুকুরডুবি, চাতলা ও কাটুয়িা বিলে পাবদা তুরাল, রাঁচি; কুইয়াচুরি বিলে বাতাসি; বালিজুরি ও লামরা বিলে সরপুটি এবং নাদবিলে চিতলমাছের প্রাধান্য রয়েছে। তাছাড়া হাকালুকি হাওরে বড় বড় ঘাগট (আইড়), কালবাউশ, কাংলা, বাইম, ভেদা বাইল্যা, চেলা, মলা, ঢেলা, কইচা, ইচা (চিংড়ি) মাছ পাওয়া যায়। ইজারাদাররা অক্টোবর মাস থেকে বিলে মাছ ধরার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। অক্টোবর মাসে তা শেষ হয়। বন্যার ফলে উজান থেকে বিভিন্ন পুকুরের ছোট বড় সব মাছ হাওরে চলে আসে। ফেব্রুয়ারিতে বিল সেচে সব মাছ ধরা হয়। এ কারণে হাওরে আগের মতো মাছ উৎপাদন হয় না। বড় আকারের দামি মাছ আজমীরিগঞ্জ, কুলিয়ারচর, ঢাকা, চট্টগ্রামে চলে আসে। আর হাওর সংলগ্ন এলাকায় পাওয়া যায় ছোট আকারের কম দামি মাছ।
হাওরে মাছ ধরার জন্য আছে জেলে সম্প্রদায়। এদের মাঝে আবার ভাগও আছে। যেমন, পেশাদার জেলেদের প্রধান পেশাই হলো মাছ ধরা। এরা ঐতিহ্যগতভাবেই জেলে সম্প্রদায়ভুক্ত। স্থানীয়ভাবে এদেরকে ফ্রিশারম্যান বা মাইমাল বলা হয়। হিন্দু মুসলিম উভয় ধর্মের লোকই এই পেশার সাথে জড়িত। হিন্দু জেলেদের বলা হয় পাঠনি। অন্যদিকে ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষিরা ফসল ফলানোর নির্ধারিত সময়ের পর জেলের কাজ করে থাকেন। এরা মৌসুমি জেলে হিেেবই পরিচিত। বর্ষকালে কাজের অভাবের কারণই তাদের এ পেশায় নামার কারণ। আরেকটি বিষেশ শ্রেণীর জেলে আছে। এদেরকে বলে খোরাকি জেলে। হাওরের পাড়ের লোকজনই সাধারণত এই কাজ করে থাকে। খাদ্যের বিনিময়ে মাছ ধরার কাজ করে তারা।
হাকালুকি হাওরে মাছ ধরার জন্য ব্যবহার করা হয় বেড়াজাল, দেররা জলা, কাঠি জাল, দোরা জাল, কারেন্ট জাল, ফাঁসি জাল, ভেসাল, দিয়ল জাল, আদা ঠেলা জাল, পেলুন, ঝাঁকি জাল ইত্যাদি। হাকালুকি হাওরের অভ্যন্তরের বিলসমূহ প্রতিবছরই লিজ দেয়া হয়। ইজারাধীন জলাশয় জলমহাল বলে পরিচিত। এর মেয়াদ থাকে ১ থেকে ৩ বছর। ১৯৫০ সালে স্টেইট একুইজিশন অ্যাক্ট প্রবর্তনের ফলে মিরাশদার শ্রেণী বিলুপ্ত হয়ে গেলেও মধ্যস্থতাকারী মৎস্যজীবী শ্রেণী ক্রমশ ইজারাদার হিসেবে আবির্ভূত হয়ে ওঠে। এইসব বিলের ইজারাদাররা সাধারণত সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার আশ্রয় গ্রহণ করে থাকেন।
হাওরে মাছ শিকার নিয়ে নানা গল্প প্রচলিত রয়েছে এখানে। হাওর সংলগ্ন কানুনগো বাজারের সালেহ আহমেদ বলেন, নজরুল ইসলাম ও জীতেন্দ্র বিশ্বাসের কাছ থেকে এ নিয়ে অনেক গল্প শোনা গেল। হাওরে মাছ শিকারের ক্ষেত্রে নাকি ‘আফদা’ বলে ভৌতিক ব্যাপার আছে। এটি রাতে জেলেদের দিকভ্রান্ত করে ফেলে। ফলে জেলেরা ভোর না হওয়া পর্যন্ত নিজ ঠিকানায় পৌঁছতে পারেন না। যদি কোনো জেলে গভীর রাতে আফদ দ্বারা আক্রান্ত হন এবং ওই মুহূর্তে বাড়ি ফিরতে চান তাহলে তাকে বিভিন্ন অশ্লীল কাজ করতে হয়। এর মধ্যে আছে উলঙ্গ হয়ে নৌকার চারদিকে প্রস্রাব করা করা। এই ধরনের কাজ করলেই নাকি আফদ থেকে মুক্তি মিলবে। এই আফদ আবার কথাও বলতে পারে। হাওরে ‘মাছের রাখাল’ বলে একটা কথা চালু আছে। এই রাখাল লাখ লাখ মাছ নিয়ে উজান থেকে ভাটির দিকে যায়। যে বিলওয়ালার তাক্বদির ভালো থাকে তিনি ওই বছরে কোটিপতি হয়ে যান। এই রাখালের প্রমাণ হলে একটি গাছের গুড়িতে করে সে চলাফেরা করে। সেও বাংলায় কথা বলে। বর্তমানে এই হাওর বেশ সমস্যাযুক্ত। যেমন- বোরো ধান চাষের সময় সার, কীটনাশক এবং রাসায়নিক ওষুধ ব্যবহারের ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে কীটনাশক ওষুধ পুরো হাওরে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে মাছের অভয়াশ্রম কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখিরা আর আগের মতো আসে না। বিরল প্রজাতির প্রাণীরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। হিজল, করোচ, বরুণ ইত্যাদি গাছ কমে যাওয়ার ফলে বন্যায় পানির তরঙ্গ প্রবাহ এবং পাড় ভাঙন বেড়ে গেছে। হাওরে ইঞ্জিনচালিত শ্যালো নৌকা ব্যবহারের ফলে পানি দূষিত ও শব্দ দূষণ হচ্ছে। হাওর প্রসঙ্গে স্থানীয়রা বেশ কিছু দাবির কথা জানালেন, রাজস্বভিত্তিক ইরাজা প্রথা বন্ধ করা, উৎপাদনমুখী ইজারা প্রথা চালু করা, মধ্যসত্ত্বভোগীদের ইজারার বিলোপ ঘটানো, বিশেষ অঞ্চলে মাছের অভয়াশ্রম গড়ে তোলা, মৎস্য সংরক্ষণ আইনের প্রয়োগ আরও জোরদার করা, জলাশয় সেচে মাছ আহরণ বন্ধ করা, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা আহরণ বন্ধ করা। হাকালুকির হাওর সম্ভাবনায় একটি হাওর। মাছ চাষসহ নানা পরিকল্পনা করে এই হাওরকে উন্নয়নের আওতায় আনা যায়। পর্যটন শিল্পের আওতায় যদি একে আনা যায় সরকারের লাভ ছাড়া ক্ষতি হওয়ার কোনো লক্ষণ সরেজমিন গিয়ে চোখে পড়েনি।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সোজা বড়লেখা বাসে বা ট্রেনে আসা যাবে এই হাওরে। ভাড়া ২০০ টাকা। সেখান থেকে পশ্চিমে চোখ মেললেই আপনার কাংখিত হাওর চোখে পড়বে।

No comments:

Post a Comment