Friday, July 27, 2012

সিলেটের শীতল পাটি



শাহীন আহমেদ
সিলেটের শীতল পাটি শীতল করে মন। গরমকালে সিলেটের প্রায় সব বাড়িতেই বিছানার চাদরের ওপর এই পাটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। গ্রীষ্মের তপ্ত দুপুরে আরাম জুরোতে এই পার্টির ওপরই ভরসা করেন তারা। এর কদর আছে সিলেট থেকে সুদূর বিলেত পর্যন্ত। পার্টি শিল্পিরা ঘুঘু ডাকা অলস দুপুরে বা বর্ষণ মুখর দিনে অথবা আকাশ ভাঙ্গা জোছনা রাতকেই বেছে নিয়ে পাটি বুনতে। এসময় ধোঁয়া ওঠা এক পেয়ালা রঙ চা’য়ের সাথে শুকনো মুড়ি আর সুখ দুঃখের গল্প হয় তাদের সঙ্গী।
মুর্তা নামক এক প্রকার সরু গাছের ছাল দিয়ে তৈরি করা হয় এই পার্টি। মুর্তা গাছ ধারালো দা বা বটি দিয়ে ৪/৫ টুকরো করে কেটে ছাল বা বেত বের করে নেওয়া হয়। এরপর বেতগুলো এক ঘন্টা পানিভর্তি টিনেরপাত্রে ভিজিয়ে, গরম পানিতে সেদ্ধ করা হয়। সেদ্ধ শেষে বেতগুলো রোদে শুকিয়ে পুনরায় ঠা-া পরিষ্কার পানিতে ৫/১০ মিনিট ভিজিয়ে ধুয়ে তোলা হয়। এরপরই মুর্তা বেত পাটি তৈরির উপাদান হিসাবে ব্যবহার যোগ্য হয়। অনেকসময় পাটিতে নানা রঙ ও চিত্রের সমাবেশও করা হয়। মুর্তা বেতের পাটি শিল্প সিলেটকে দেশে বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিত করেছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাটি তৈরিতে হিসাব হল ৪ বেতে এক আনা আর একচিরে থাকে ২০-২০ আনা। পতন, গড়ন ও মুড়ি (জোড়া)-এভাবেই এগিয়ে চলে পাটি তৈরির কাজ। মুর্তা সাধারণত নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর পাড়, ডোবা ও জলাভূমিতে জন্মে। কেউ কেউ ধানের জমিতে, ডোবা বা কর্দমাক্ত ভূমিতে মুর্তা গাছের চাষ করে। প্রাচীন আমলে জৈন্তিয়া থেকে নৌকাযোগে মুর্তা গাছ কিনে আনতে হয়। এখন স্থানীয়ভাবে মুর্তার চাষ হয়। সিলেটের দ্বাস সম্প্রদায় এই পেশার সাথে জড়িত। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সংসারের আর্থিক দৈন্য কাটিয়ে উঠতে ঘরে বসে পাটি তৈরির কাজে অধিক সময় ব্যয় করে থাকে। এক্ষেত্রে কোন কুসংস্কার নেই। যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষ, বিবাহিত-অবিবাহিত যে কেউ ইচ্ছেমত পাটি তৈরি করতে পারে। এজন্য তারা কোন বিশেষ প্রশিক্ষণ লাভ করেননি, বরং পরিবার থেকেই এই পাটি তেরির শিক্ষা লাভ করে থাকে। যতœ সহকারে ব্যবহার করলে একটি শীতল পাটি একাধারে ২৫/৩০ বছরও ব্যবহার করা যায়। বেতের প্রস্থের মাপে শীতল পাটির নামকরণ করা হয়। যেমন সিকি, আধলী, টাকা, নয়নতারা, আসমানতারা, জোড়াকে চিরা প্রভৃতি। তাছাড়া নামকরণ ছাড়াও শীতল পাটি বাজারে পাওয়া যায়। বিভিন্ন পাটির বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো-
সিকি
সিকি মুদ্রার সমান প্রস্থ বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের জোড়াছাড়া এই পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ কারিগরের ৪/৫ মাস সময় লাগে। এই পাটি খুব মসৃণ হয়। প্রবাদ আছে যে, মসৃণতার কারণে এই পাটির উপর সাপ পর্যন্ত চলতে পারে না।
আধলী
আধলী মুদ্রার সমান প্রস্থ বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের একটা পাটি তৈরি করতে একজন দক্ষ কারিগরের সময় লাগে জ্জ মাস।
টাকা
টাকা মুদ্রার সমান প্রস্থের বেতের ৭ ফুট বাই ৫ ফুট মাপের একটা পাটি তৈরি করতে কারিগরের সময় লাগে ২/৩ মাস। সবধরনের পাটিতেই কমবেশী জোড়া দিতে হয়। জোড়া তিন প্রকারের- ছিটাজোড়া,দুই জোড়ার চেয়ে ছিটা জোড়া ও তিন জোড়া দেয়া পাটি তুলনামূলক ভাল ও টেকসই হয়ে থাকে। সাধারণত সাড়ে তিন হাত প্রস্থ ও পাঁচ হাত দৈর্ঘ্যরে বিভিন্ন প্রকার পাটি তৈরির সময়কাল ও ক্রয়মূল্য এরকম শীতল পাটি তৈরি করতে সময় লাগে ১ থেকে ২ মাস, দাম ৩ হাজার টাকা থেকে ৭ হাজার টাকা। রঙিন বেতের পাটি, সময় ৭ থেকে ১০ দিন, দাম ৩শ টাকা থেকে ৫শ টাকা। সরু বেতের পাটি তৈরিতে সময় লাগে ১ থেকে দেড় মাস। দাম ১ হাজার থেকে ৪ হাজার টাকা, সাদা বা সাধারণ পাটি তৈরিতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ দিন। দাম ২৫০ টাকা ৩৫০ টাকা। কমলকোষ পাটি তৈরিতে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ দিন। এর দাম পড়বে ২শ’ থেকে ২৫০ টাকা। আরও আছে আড়–য়া এবং তাজমহল পাটি। তাজমহল পাটি নামকরণের কারণ হল, এটি তাজমহলের চবি সম্বলিত। এটি তৈরিতে অনেক সময় লাগে। দামও অনেক বেশি। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার অনেক থানাতে শীতল পাটি তৈরি করা হয়। এর মধ্যে বালাগঞ্জ ও দাসের বাজার শীতল পাটির জন্য প্রসিদ্ধ। বড়লেখা থানার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দাসের বাজারে প্রতি বৃহস্পতিবার ও রোববার নানা জাতের পাটির বিশাল হাট বসে। প্রতি বাজারে পাটি ওঠে প্রায় ১শ’ থেকে ৪শ’টির মত। প্রতি বাজার বারে পাটির বিক্রয় মূল্য লক্ষাধিক টাকায় দাঁড়ায়। পাটি খুচরা ও পাইকারী বিক্রয় হয়। তারপর এই বাজার থেকে পাইকাররা পাটি কিনে তা সারাদেশে ছড়িয়ে দেন। ওপরের এইসব তথ্য জানালেন স্থানীয় দাসের বাজারের কারিগর মতিলাল দাস ও নলিনীকান্ত দাস।
পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেই শীতল পাটি সমাদৃত হয়ে থাকে। আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানী, জাপান, ফ্রান্সসহ আরও অনেক দেশেই এর চাহিদা রয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টগুলোতে এই শীতল পাটি ডেকোরেশনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিয়ে, শ্রাদ্ধ, বর-কনে সাজাতে এই পাটির ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। সিলেটের হিন্দু-মুসলিম সকলেই বিয়ের কনের সাথে একটি শীতল পাটি উপহার দিয়ে থাকেন, মুসলিমরা নামাজের পাটি হিসেবেও এটি ব্যবহার করেন। কথিত আছে, দাসের বাজারের রূপালী বেতের শীতল পাটি মুর্শিদ কুলী খাঁ সম্রাট আওরঙ্গজেবকে উপহার দিয়েছিলেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে দুর্লভ এই হস্তজাত কুটির শিল্পের বিকাশ ব্যহত হচ্ছে। হতদরিদ্র পাটি শিল্পীরা কৃষিকাজ বা অন্যান্য শ্রমযুক্ত কাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। এমনকি অনেকে মধ্যপ্রাচ্যেও পাড়ি জমাচ্ছেন। কারণ, এই পাটি তৈরি অত্যন্ত শ্রমনির্ভর কাজ। সময় লাগে বেশি এবং তুলনামূলক লাভও হয় কম। এছাড়া পাটি তৈরির উপাদান-মুর্তা, রং ইত্যাদি সহজলভ্য না হওয়াতে পাটি শ্রমিকরা জীবিকা নির্বাহের জন্য বিকল্প কাজ খুঁজছেন। স্থানীয় পাটিশিল্পীরা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছেন- সরকার যেন আবাদি খাস জায়গাকে মুর্তা চাষের জন্য বরাদ্দ করে দেন এবং পার্টি শ্রমিকদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করেন। তাহলেই হয়ত এর রপ্তানির মাধ্যমে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে।

No comments:

Post a Comment