শাহীন আহমেদ
শিকার যে শুধু বন্যপ্রাণী হত্যা করা তা কিন্তু সকল অর্থে ঠিক নয়। একসময় দেশের বিভিন্ন জনপদে অনেক বন্যপ্রাণী ছিল। এসব প্রাণী মানুষের ক্ষতি করত। আবার মানুষের মধ্যে কেউ কেউ সাহস দেখানোর জন্যে তাদের শিকার করত। সালেহীন রেজা এই সাহসী দলেরই একজন। পুরনো ঢাকার লালবাগের মানুষ। বাবা শিকারী ছিলেন। দাদাও ছিলেন তাই। রক্তের ধারাবাহিক সম্পর্কের কারণে তিনিও হাতে তুলে নেন বন্দুক, পর্যায়ক্রমে হয়ে ওঠেন সাহসী শিকারী। তিনি তার শিকার সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন বিখ্যাত কিছু মানুষ। এদের মধ্যে ছিলেন পচাব্দী গাজী, আকতারুজ্জামান কামাল (বাঘমামা), ওয়াহিদ উদ্দিন এবং রফিক। সালেহীন রেজা শিকার ছেড়েছেন প্রায় দুই দশক। কিন্তু দেশেরপথের সঙ্গে আলাপচারিতায়
সে সময়ের নানা অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন - শাহীন আহমেদ।
দেশেরপথে: শিকারের আগ্রহ কীভাবে আপনার মধ্যে তৈরি হলো?
সালেহীন রেজা : আমার বাবা ছিলেন শিকারী। দাদাও তাই। ছোট বেলায় বাবা আমাদের সঙ্গে নিয়ে পাখি শিকারে যেতেন। বিশেষ করে মিরপুরের বর্তমান ইনডোর স্টেডিয়াম যেখানে, সেখানে আমাদের বাগান বাড়ি ছিল। অনেক পাখি ছিল। বাবার শিকার করা পাখি আমরা শৈশবে খেতাম। বলতে পারেন বাবার কাছ থেকেই শিকারের আগ্রহ আমার মধ্যে জন্ম নেয়।
দেশেরপথে: শুরু কীভাবে?
সালেহীন রেজা: আমি পুরনো ঢাকার লালবাগের বাসিন্দা। ওখানকার কয়েকটি আদি পরিবারের একটি আমাদের পরিবার। বাড়ির পাশেই লালবাগের উন্মুক্ত কেল্লা। তখনও কেল্লায় সবদিকে দেয়াল ছিল না। কেল্লাায় ঘুরে বেড়াতাম। শৈশবে খুব দুরন্ত ছিলাম। ইট-পাটকেল দিয়ে পাখি, কবুতর মেরে ফেলতাম। কোনো গাছে পাখি বা কবুতর না পেলে শুধুই ঢিল ছুড়তাম। তবে যে কাজটা নিয়মিত করতাম তা হলো কেল্লায় একটি পুকুর ছিল, সেই পুকুরে নিয়মিত সাঁতার কাটতাম। সাঁতার বলতে পানিতে শুধু ঝাপাঝাপি করা। পুকুরে প্রচুর ঢোরা সাপ ছিল। নিয়মিত সাপ মারতাম। বলতে পারেন এই সাপ মারা আমার শৈশবের সাহসী শিকার। তবে মনে পড়ে ক্লাস সিক্সে যখন পড়ি তখন একদিন সকালে বড় ভাইয়ের দু’নলা বেলজিয়াম বন্দুক নিয়ে বাড়ি থেকে বের হই। সোজা মিরপুরে চলে যাই এবং সেখানে গিয়ে পাখি শিকার করি। প্রথম পাখিটা শিকার করার পর ওর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। মনে মনে খুব খুশি হই। মন বলে ওঠে, বাহ আমি তো শিকারী। সেদিন অনেকগুলো স্নাইপ- বোগতি পাখি শিকার করি। বাড়ি ফিরে আসি মহা আনন্দে। মনে মনে ভাবতে থাকি বাড়ি গেলে মা, বড়ভাই খুব খুশি হবেন। কিন্তু বাড়ি ফেরার পর দেখি উল্টো চিত্র। তারা আমার উপর অনেক বিরক্ত। মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে শিকারের নেশা আমার আরো বেড়ে যায়।
দেশেরপথে: তারপর?
সালেহীন রেজা: তারপর পর্যায়ক্রমে শিকার করতে যাই সাভার, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ভোলা, ময়মনসিংহ, চাঁদপুর, নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ এসব স্থানে। নরসিংদীর নিরমিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কাজলা, বিরুইল্লা, বটগর, নবীনগর, সোনারগাঁর নুনের টেক ও দাউদকান্দির হারামজাদার চরে অনেক পাখি শিকার করেছি। তবে এ শিকার করতে গিয়ে অনেক কষ্টের মুখোমুখি হয়েছি। শীতে, বৃষ্টির রাতে খোলা নৌকায় শুয়েছি। শীতের সকালে ধানী জমির আলে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাছের উপর রাত কাটিয়েছি। যৌবনের সেই দিনগুলোর কথা যখন মনে পড়ে তখন নিজেরই কেমন যেন লাগে। আমার শিকারে সঙ্গী হিসেবে পেতাম শিকারী ওয়াহিদ উদ্দিন, শিকারী রফিক ভাইকে। রফিক ভাই ছিলেন বড় শিকারী। তিনি আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। তিনি আমাকে পরে একটি ব্রুনো-২ বন্দুক উপহার দিয়েছিলেন। তার বাড়ি ঢাকার মাতুয়াইলে। উনাদের বাড়ির পুকুরে মাছ ধরতে যেতাম। রফিক ভাই খুব সাহসী ও চালাক শিকারী ছিলেন। ঢাকা-সাভার রোডে ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে সাভারের নয়ারহাট গজারীবনে আমরা প্রচুর খরগোশ (ফইট্টা) শিকার করেছি। খরগোশ শিকারের বিষয়টা ছিল বেশ মজার। জিপ গাড়ির লাইট বনের একদিকে রাখলে খরগোশগুলো লাইট দেখতে বের হতোÑ তখন আমরা শিকার করতাম। এখানে একটু বলি, রফিক ভাই হলেন বঙ্গবন্ধুর পুত্রবধূ সুলতানা কামালের বড় ভাই। আবার হাওরের গল্প শুনাই। হাওরে এতো মাছ ছিল যে, প্রায় সময় মাছ লাফিয়ে নৌকায় উঠে যেতো। মাছে ভাতে বাঙালি যে কথা প্রচলিত আছে তা তখন দেখেছি। পানিও ছিল অনেক। শতকে শতক, হাজারে হাজার। আমার শিকার জীবনে এই মুহূর্তে মনে পড়ছে মিরপুরের উসমান আলী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উজির আলী মাঝির কথা। এরা ছিলেন আমাদের সুখ-দুঃখের সঙ্গী। একদিনের ঘটনা বলিÑ মিরপুরে পাখি শিকার করতে গেছি। হঠাৎ একটি সাপ দেখি পানি দিয়ে যাচ্ছে। আমি লালবাগের কেল্লার পুকুরে ঢোড়া সাপের মতো মনে করে খপ করে ধরে ফেলি। পরে মাঝে চিনে ফেলে এটি ছিল বিষাক্ত কালকেউটে। তখন উসমান মাঝি বলে,
সাবধান; সাপ ছাড়বেন না।
পরে আমরা সাপটাকে মেরে ফেলি। মাঝি ভয়ংকর ভয় পায়।
আরেকদিনের গল্প শোনাই, মিরপুর এলাকায় গেছি, মনের আনন্দে পাখি শিকার করছি। হঠাৎ দেখি বালির মধ্যে আমি ডুবে যাচ্ছি। প্রায় বুক পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। পরে উসমান মাঝি বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। সেই স্মৃতি মনে পড়লে আমার গায়ের লোম এখনও দাঁড়িয়ে যায়।
আরেকটা গল্প বলি, আমি ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করি না। কিন্তু একদিন রাতে পাখি শিকার করছি, একটি পাখির উপর গুলি করলাম। কিন্তু পাখির গায়ে লাগলো না। আরো বারকয়েক গুলি চালালাম, কিন্তু না, এবারও গুলি লাগল না। আমার সঙ্গীরা প্রচ- ভয় পেয়ে যান। তাদের ধারণা এটি ভূত হবে। কিন্তু কেন পাখির গায়ে গুলি লাগলো না সে রহস্য আজো জানা গেল না। এমন তো নয় যে, আমার হাতের দিশা ঠিক নেই। আমি কিন্তু তখন উড়ন্ত পাখির গায়ে গুলি বসিয়ে দিতাম।
দেশেরপথে: সুন্দরবন ভ্রমণ নিয়ে কিছু বলুন?
সালেহীন রেজা: সুন্দরবন ভ্রমণের আগে শিকারী পচাব্দী গাজীর গল্প শুরুতে কিছুতে কিছুটা করে নেয়া দরকার। ১৯৮৫ সালের দিকে ইসলামপুরের বিখ্যাত বন্দুকের দোকান শিকার ও শিকারীর মালিক ডাঃ নাসির সাহেবের দোকানে আড্ডা দিতাম। সেখানেই পরিচয় বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজীর সঙ্গে। তখন সুন্দরবনের আরেক শিকারী আকতারুজ্জামান কামাল ও ছিলেন। পচাব্দী গাজীর বাড়ি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী এলাকায়। তিনি ঢাকায় এলে সব শিকারী ডাঃ নাসির সাহেবের দোকানে আড্ডায় যোগ দিতেন। তখন সবার মধ্যে একটা আনন্দভাব থাকতো। এভাবে আড্ডার মাধ্যমে গাজী সাহেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেড়ে যায়। সে সম্পর্ক আমি তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ধরে রাখি। গাজী সাহেব পরে ঢাকায় এলে আমার বাসা বা আমার নিজের হোটেলে তাকে যতœ করে রাখতাম। যতœ করতাম এ কারণে যে, তিনি নিজে প্রায় ৫০টির অধিক বাঘ শিকার করেছেন। ১৯৮৬ সালে আমার সম্বন্ধি ইসলাম উদ্দিনসহ আমরা গাজী সাহেবের সঙ্গে সুন্দরবনে যাই। জীবনের প্রথম সফর। অনেক স্বপ্ন ছিল এই বনে আসবো। অনেকে এটাকে বনের রাজাও বলেন। এখানে এলে বাঘের দেখাও মিলতে পারে। আর সঙ্গী আছেন বিখ্যাত শিকারী পচাব্দী গাজী। এখানে একটু বলতে চাইÑ ওই সময় ঢাকায় শুটিংক্লাবের উদ্যোগে শুটিং কমপিটিশন হবে। আমাকে তার বিচারক হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। এখানে যুক্ত হওয়া ছিল অনেক প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। কিন্তু প্রোগরামের সঙ্গে যুক্ত হইনি। কারণ, গাজী সাহেবের সুন্দরবনে যাবো। আমি গুরুত্ব দিয়েছি সুন্দরবন যাওয়াকে। এবার আসি মূল গল্পেÑ যখন বুড়িগোয়ালিনী পৌঁছলাম তখনই মন ভরে গেলো সেখানকার দৃশ্য দেখে। বুড়িগোয়ালিনীর ফরেস্ট স্টেশনের চারপাশে তখন ছিল গভীর বন। হাতে চালিত ছইঅলা নৌকায় আমাদের যাত্রা শুরু হলো। আমার মধ্যে খুশি খুশি ভাব। কতো গল্প শুনেছি এই বনের। বাঘ, হরিণ, সাপ কতো বন্য প্রাণী আছে এখানে। আস্তে আস্তে সব কিছু দেখবো। বনে চলার সব নির্দেশনা দিচ্ছেন গাজী সাহেব। পানিতে হাত বা পা রাখবো না কারণ করাত মাছে কেটে ফেলতে পারে। এই মাছ আঘাত করলে রক্ত বন্ধ হয় না। কাজেই সাবধান। সবসময় চোখ খোলা রাখতে হবে। কারণ যে কোনো সময় বাঘের সঙ্গে দেখা হতে পারে। দলবেঁধে থাকতে হবে। কারণ বাঘ দলবদ্ধ মানুষকে আক্রমণ করতে পারে না। বনে নেমে পা সাবধানে রাখতে হবে। যেকোনো সময় পা কেটে যেতে পারে। ঘাসপথে সাবধানে চলতে হবে কারণ ঘাসের মধ্যে অজগর লুকিয়ে থাকে। প্রথমবার সুন্দরবন যাবার মোহমুগ্ধতা এখনও আমার চোখে লেগে আছে। তখন সুন্দরবনে দেখেছি প্রচুর গাছপালা, নদীতে কতোজাতের মাছ। প্রায় সাত কেজি ওজনের কাইন মাছ দেখেছি। হরিণ, বাঘ ছিল অনেক। তখন বনে ট্যুরিস্টরাও যেতেন না বললেই চলে। মৌয়াল, বাওয়ালী ও জেলেরা যারা পারিবারিকভাবে স্থায়ী, তারাই শুধু বনে থাকতো। বাইরের কেউ যেত না। কারণ অন্যদের ভয় ছিল যে, বনে যারা যাবে তারা আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। সুন্দরবন নিয়ে হাসির একটা বিষয় বলিÑ আমার ধারণা ছিল গোলপাতা গোল হয়। কিন্তু বাস্তবে ছিল তার উল্টো।
সুন্দরবনে এরপর অনেকবার গেছি। টুকটাক শিকার করেছি। প্রতিবার সঙ্গে পেয়েছি শিকারী পচাব্দী গাজী ও আকতারুজ্জামান কামালকে। দু’জনের অকৃত্রিম ভালোবাসা আমি পেয়েছি। এ দু’জনের কাছ থেকে দিখেছি সুন্দরবনকে কীভাবে ভালবাসতে হয়। যারাই বন নিয়ে কোনো কাজ করতে চেয়েছেন বা বনে যেতে চেয়েছেন তারা সাহায্য পেয়েছেন পচাব্দী গাজীর কাছ থেকে। পচাব্দী গাজী ছিলেন অত্যন্ত লাজুক স্বভাবের মানুষ। প্রথম তাকে দেখে আমি খুব অবাক হই। কারণ আমি মনে করেছিলাম তিনি উঁচু, বিশালদেহী হবেন। বাস্তবে দেখলাম ছোটখাটো একজন মানুষ। চরম অভাবে তার দিন গেছে, কিন্তু কোনোদিন কারো কাছে হাত পাততে দেখিনি।
দেশেরপথে: পারিবারিক জীবন নিয়ে কিছু বলুন?
সালেহীন রেজা: আমিতো শিকারের পেছনে লেগেই থাকতাম। বাড়িতে মন বসতো না। আমার মা পরে আমাকে গৃহী করার জন্যে বিয়ের ব্যবস্থা করেন। রূপবতী স্ত্রী। তারপরও আমি ঘরে মিথ্যে বলে যেতাম। বউ প্রথম প্রথম অভিমান করতো। পরে বিরক্ত হতো। আমার প্রথম সন্তানের জন্মের পর ধীরে ধীরে শিকারের নেশা কিছু কমে যায়। পরিবারের দিকে বেশি মনোযোগী হই। তারপর থেকে আর শিকারের পথে পা বাড়াইনি। তবে শিকার বা বেড়াবার টান এখনও মন থেকে মুছে যায়নি। টেলিভিশনে এখনও বন্যপ্রাণী বা ভ্রমণের ডকুমেন্টরিই বেশি দেখি।
No comments:
Post a Comment