শাহীন আহমেদ
পাহাড়ের চারদিকে সবুজের পরিবেশ। ওপরে নীল আকাশ, নিচে থরে থরে সাজানো আকাশ চুম্বি পাথারিয়া পাহাড়। এখানে আকাশের কোনো অহংকার নেই। বিশাল পাহাড় মাথা উঁচু করে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্ববিধাতা যেনো পাহাড়টিকে তুলির অপূর্ব আঁচড়ে অপরূপ রূপে রূপায়িত করেছেন। ২৫ মাইল ব্যাপী এর বিস্তার। ধারণা করা হয়, এই পাহাড়ের জন্ম মায়োসিন কালের মধ্য ভাগে, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি লক্ষ বছর আগের। এই পাহাড় প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ। এখানে আগর নামে এক ধরনের গাছ পাওয়া যায়। এর বৈজ্ঞানিক নাম এগলাইরিয়া এগাইলকা, এর থেকে মূল্যবান আতর তৈরি হয়, যার কদর রয়েছে সৌদি আরব থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত পুরো আরব জুড়ে। ওখানে প্রতি কেজি আতরের দাম আনুমানিক দশ থেকে পনের লাখ টাকা। মূল আগরকাঠ জ্বালিয়ে রাখলে পারপাশে সুগন্ধিতে ভরে ওঠে। পাথারিয়া পাহাড়ে আছে তেলকূপ, এখান থেকে তেল উত্তোলনের জন্য বার্মা অয়েল কোম্পানি (বিওসি) ১৯৫৩ সালে তেলকূপ খননের চেষ্টা চালানোর সময় পাইপ ফেটে পড়ে। তিনদিন তেলের বন্যা বয়ে যায়। আজও কাঠালতলী অঞ্চলে ধানি জমিতে কৃষকের লাঙ্গলের ফলা থেকে জলযুক্ত মাটিতে তেল ভেসে ওঠে। বর্তমানে এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। এ তেলকূপের ঢাকনির ওপর কান রাখলে তেলের গমগম শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। পাহাড়ে বাঘের বাচ্চা মায়ের দুধ খাবার সময় মাটিতে দুধ পড়ে যেতো। সে দুধ শুকনো হয়ে জমাট বেঁধে থাকত। এটি অত্যন্ত দুর্লভ ছিল। পরে তা সংগ্রহ করা হতো। বাঘের দুধ দিয়ে অতি প্রয়োজনীয় ঔষধ তৈরি করা হতো। কবিরাজরা অত্যন্ত কষ্ট করে তা সংগ্রহ করতেন। পাহাদে হরহামেশা পাওয়া যেত হাতি, হাতির দাঁত, গ-ারের চামড়া ও মধু। সবচে জরুরি যে জিনিসটি পাওয়া যেত তা হচ্ছে খনিজ জল। পাহাড়ের দক্ষিণপ্রান্তে সাঙ্গন (হাঙ্গন) পেতে গ-ার ধরা হতো। এর নামকরণ হয়েছে পাতিলাসাঙ্গন। খেদা করে ধরা হতো হাতি। এজন্য এর নাম রাখা হয় গজভাগ। এক সময়ে বড়লেখার আদিত্য পরিবারের তত্ত্বাবধানে গজভাগ থেকে হাতি ধরে মুর্শিদাবাদ ও দিল্লিতে চালান দেওয়া হতো। অন্যরা গ-ার শিকার করতে প্রস্তুত করতো ঢাল। তা চালান দিতো পুরো ভারতে। পাথারিয়া পাহাড়ে বেশ ক’টি লবণ খনি ছিল।
পাথারিয়া পাহাড়ের বাঘ, পাখি, হরিণ, হাতি, হাতির দাঁত, বন্য শুকরসহ নানা ধরণের পাখি, মূল্যবান গাছপালার স্মৃতিময় ডালা এখন স্থানীয় মুরব্বীদের মুখে নস্টালজিয়া মাত্র। চল্লিশের দশকে পাথারিয়া পাহাড়ের কি অবস্থা ছিল উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দ্বিজেন শর্মার জবানিতে তা এভাবে ফুটে ওঠে- ‘আমাদের গাঁ থেকে পাথারিয়া পাহাড়ের সংরক্ষিত বনাঞ্চল পর্যন্ত চার মাইল দীর্ঘ গোটা পথটি গাছগাছালিতে নিবিড় ছিল, কাঠালতলী স্টেশন পেরিয়ে মাইল খানেক পূর্বে গেলেই বনমোরগ, তিতির, শ্যামা, ভিমরাজ, বানর দেখা যেত। আরেকটু এগোলেই শোনা যেত হনুমানদের একঘেয়ে জিগির, দৈবাৎ হরিণের ডাক। আশংকা ছিল বুনো শুকরের সঙ্গে মোলাকাতের। পাহাড়ের কাছে আমাদের একটি ছোট বাড়ি আছে। কৈশোর থেকেই সেখানে যাতায়াত, বসবাস। কত যে বিচিত্র পাখি দেখেছি, রামধনুর সাতরঙের বেশি রঙধারী পাখি ছিল। পাকুড় গাছে ফল পাকলে আসত হরিয়ালের ঝাঁক। আজ আর তার একটিও টিকে নেই। একদিন পাহাড়ের উঁচু টিলার চুঁড়োয় পৌঁছাই। হাপাতে থাকি, এক উঁচুতে আর কোনোদিন উঠিনি। অবাক হয়ে চারদিকে তাকাই। এমন আশ্চর্য দৃশ্যপট কোনোদিন দেখিনি। পূর্বে তাকিয়ে দেখি পাহাড়ের পর পাহাড়, পশ্চিমে বিস্তীর্ণ প্রান্তর, জলাভূমি, আঁকাবাঁকা নদীর রেখা, তারপর আকাশ আর মাটির মেলামেশা। হঠাৎ চোখে পড়ে নিচে যেন পাহাড়ের গা-ঘেঁষে পোকার মতো কী একটা হাঁটছে! আসলে ওটা চারমাইল দূরের রেলপথে চলমান একটা ট্রেন। তখনই এই বিস্তীর্ণ নিসর্গ দৃশ্যের দূরত্ব সম্পর্কে বোধোদয় হয়। রেল সড়কের লাগোয়া আমাদের গ্রামটি পাহাড়ের গায়ে যেনো সেঁধে আছে, দূরের উজ্জ্বল জলরাশি দশ-পনের মাইল দূরের হাকালুকির হাওর এবং তারপর জেলা সদর সিলেট পর্যন্ত খোলা মাঠ। হঠাৎ দেখি নিবিড় বনের ফাঁক গলিয়ে একগুচ্ছ আলো, পাতাগুলো ঝলমলিয়ে উঠেছে। তারপর দেখি বাঘের তরতাজা পায়ের দাগ, আমরা তখন জঙ্গল ছেড়ে লোকালয়ের সাঁওতাল পল্লীর দিকে দ্রুত দৌড়াতে থাকি।’ পাথারিয়া পাহাড়ের প্রাকৃতিক অবস্থা সম্পর্কে দ্বিজেন শর্মাকে মনে হল যেন সাক্ষাৎ উদ্ভিদ জগতের মহারাজা। তিনি শোনান- ‘পাহাড়ে বড় বড় গাছ, বাঁশঝাড়, অজস্র জাতের লতা, পাথর, পাথরের গায়ে রেশমি সবুজ শ্যাওলার আস্তর। ঢাউস পাতার বুনো রাম কলার জোঁপ, হলুদ হয়ে ওঠা ঘাস, আমাদের পাহাড়ে অনেক সুন্দর সুন্দর ফুলগাছ দেখেছি। অশোক, দেবকাঞ্চন, কনকচাপা, পারুল, জংলী, জুঁই, নাগপল্লী, লুটকি, নীললতা, ল্যাডিস আম্রেলা, ডুলিচাপা, ম্যাগনলিয়া আরও কতো নাম না জানা ফুল, ফল, পাখি, জীব, জন্তু দেখতে পাওয়া যেত।’
নবাবী আমলে পাথারিয়া পাহাড় ও এর আশপাশের জঙ্গল ছিল কুকিদের আস্তানা। এক সময় এ অঞ্চলে কুকি নয় এমন মানুষের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। কুকিরা মানুষের মাংস খুব পছন্দ করত। প্রায়ই তারা সমতল অঞ্চলে হানা দিয়ে নর-নারী ও শিশু বন্দি করে নিয়ে যেত। ছাগল বা ভেড়ার পালের মতো চালান করা হতো তাদের আস্তানায়। এসব বন্দিদের অনেককেই জবাই করে উদরপূর্তি করা হতো। তবে সুন্দরী নারী থাকলে তাকে তারা রেখে দিত অথবা উপহার স্বরূপ ত্রিপুরা বা অন্য কোথাও পাঠাতো। পাথারিয়া পাহাড়ে রয়েছে দূরবীন টিলা, গজনটিলা ও রাজবাড়ি নামে তিনটি উল্লেখযোগ্য শৃঙ্গ। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ২৪৪ মিটার। আর হাতের মাপে ৫৩৪ হাত। একতলা দালানকে যদি ৮ হাত ধরা হয়, তবে এর উচ্চতা হবে বাংলাদেশের শিল্প ব্যাংকের মতো প্রায় ৩টি উঁচু দালানের মতো। বর্তমানে পাথারিয়া বনাঞ্চলকে দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল ও মানবসৃষ্ট বনাঞ্চল। প্রশাসনিক কাজের সুবিধার্তে এই বনাঞ্চলকে তিনটি বিটে বিভক্ত করা হয়েছে এগুলো হলো- ক. বড়লেখা বিট, খ. মাধবছড়া বিট, গ. সমনবাগ বিট। তিনটি বিটের মোট ভূমির পরিমাণ ৯১৮৭.৫৫ একর। বর্তমানে পাথারিয়া বনাঞ্চলে রয়েছে শুধু বাঁশ, বেত ও কিছু গাছ-গাছড়া। মূল্যবান বৃক্ষ বলতে কিছু নেই। চাম, সুন্ধি, করই, বামঢালা, গামারি, চাপালিকা, জারুল প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের মূল্যবান বৃক্ষে সমস্ত বনাঞ্চল ছিল ভরপুর। প্রাকৃতিক বনাঞ্চলকে চারটি মহালে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- ক. নিকড়ি বাঁশ মহাল, খ. ষাটমাছড়া বাঁশ মহাল, গ. মাধবছড়া বাঁশ মহাল এবং ঘ. লাতু ধলছড়া বাঁশ মহাল।
পাথারিয়া পাহাড় নিয়ে একটি জনশ্রুতি এরকম, সুদূর অতীতকালে বাঁশ কাটতে গিয়ে এক দিন মজুর এক কলসি সোনার মহর পেয়েছিল। পাহাড়ের বাঁশ শ্রমিকেরা আজও গভীর জঙ্গলে গাছের পাতার ফাঁক ফোকরে গভীর মনোযোগে সোনার মহর খুঁজে থাকেন বলে স্থানীয়রা জানান। পাথারিয়া পাহাড়ের হরিণ খাওয়ার লোভে বাঘ পাহাড়ের নিচে জনারণ্যে চলে আসত। পাথারিয়া পাহাড়ের হরিণ খাওয়ার লোভে বাঘ পাহাড়ের নিচে জনারণ্যে চলে আসত। পাথারিয়া পাহাড়ের গভীর অরণ্যে মাধবকু-ের তৎকালীন বাসিন্দা শ্রী কালী প্রসন্ন দাসের সাথে আলাপ হয়। তিনি ৭০ দশকের গল্প আমাদের এভানে শোনান- ‘মাধবকু-েই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পাহাড়ে বাঘের অবস্থা ছিল অনেকটা গ্রামের শেয়াল দেখার মতো। আমরা বর্ষা মৌসুমে একটা, দুটো কিংবা তার চেয়ে বেশি বাঘ দেখতাম। মাধবছড়ায় বাঘকে পানি থেকে কিংবা চা বাগানের সরু পথ দিয়ে বাঘকে লেজ নেড়ে যেতে দেখেছি। কতোদিন স্কুলে যেতে কিংবা স্কুল থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলায় বাঘের মুখোমুখি হয়েছি। একদিনের ঘটনা, শৈশবে আমি আমাদের বাড়ির গৃহভৃত্যের কোলে ছিলাম। এ সময়ই বাঘ এলো গরুর উপর আক্রমণ করতে। বাঘ দেখে সুরেন্দ্র মামা তীব্র হুংকার দিলে বাঘ চলে যায়। বাঘ মামার সাথে সুরেন্দ্র মামার ধমকাধমকির স্মৃতি আমার মন থেকে আজও মুছেনি। আমাদের অনেকগুলো গাভী ছিল, বাঘ প্রায়ই গাভীদের উপর আক্রমণ করতে আসত। উপায়ন্তর না দেখে বাঘ মারার জন্যে বন্দুকধারী শিকারী কাঁঠাল গাছের ওপর মাঁচা করে ওৎ পেতে বসলেন। বন্দুকে গুলিভরা, বাঘও এলো, কিন্তু ছুঁড়তে পারলেন না। পাহাড়ে বাঘ ছাড়াও এক পাল বন্যহাতি আসত। পাহাড়ে আমি জন্মের পর দু’যুগ ছিলাম যেখানে আমাদের বাড়ি ছিল, আজও সেখানে বাঙালি জনবসতি গড়ে ওঠেনি।’ সত্তর দশকের অরণ্যে লালিত এই শিশুসন্তানটি বর্তমানে ঢাকার সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের দর্শন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। পাথারিয়া পাহাড়ের বাঘের ব্যাপারটা স্থানীয়দের কাছে মুখরোচক গল্পের বিষয়। জনশ্রুতি আছে বাঘ মানুষকে খেলেও পীর-ফকির, সাধু-সন্নাসীদের সাথে ভাল ব্যবহার করত। এমনকি বাঘ পীরদের পোষ্য কুকুরের ন্যায় খাদিমের মতো কাজ করত। অতীতকালে স্থানীয়দের অদ্ভুত একটি ধারণা ও লোকাচার ছিল। যদি কারও সন্তান না হতো তবে বাঘের গায়ের ওপর পা রেখে স্নান করলে তিনি সন্তান ধারণ করতে পারবেন। এতে বাঘ এলা’ দূর হবে। এরকম একটি ঘটনার উদাহরণ ঘোলসা এলাকায় প্রায় ৯০ বছর বয়ঃবৃদ্ধ শ্রীমতি তরঙ লতা দাস। বিয়ের অনেক বছর পরও সন্তান না হওয়ায় শাশুড়ী তাকে এই কাজে উৎসাহ যোগান। এলাকায় তখন শীত মৌসুমে প্রচুর বাঘ শিকার হতো। তিনি মৃত বাঘের উপর পা রেখে স্নান করেছিলেন। শুরুতে ভয়ে তার পিলে চমকে গিয়েছিল। তখন শ্বশুড়বাড়ির সবাই তাকে সাহস যুগিয়েছিল। এর কিছু দিন পর তিনি প্রথম সন্তান ধারণ করেন। তরঙ্গলতা দাস অরণ্য শোভিত পাথারিয়া পাহাড়ের ৫০ বছরের সচক্ষু দর্শক। তার সাথে বাঘের কতো যে দেখা হয়েছে তার কোনো হিসেব নেই। ছড়া থেকে জল আনতে গিয়ে প্রায় তিনি বাঘদের খপ্পড়ে পড়তেন। তবে অত্যাশ্চর্য হলো বাঘরা কখনো তাকে আক্রমণ করেনি। এ যেন এক জংলী রাণীর গল্প। পাথারিয়া পাহাড়ে শীত মৌসুমে গভীর অরণ্য থেকে বাঘ জনারণ্যে নেমে আসত। জঙ্গল থেকে নেমে আসা বাঘ, গরু-মহিষের জান নিলেও সে নিজে জান নিয়ে ফিরে যেতে পারত না। কারণ, স্থানীয়রা বাঘ শিকারে বড়ই ওস্তাদ। বাঘ শিকার হতো শীত মৌসুমে। এটি খুব উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্যে দিয়ে উদযাপিত হতো। পাহাড়ে বাঘ দেখা গেছে বা কারো বাড়িতে আক্রমণ করেছে অথবা কারও বাড়িতে বাঘের পদচিহ্ন কিংবা বাঘের গর্জন শোনা গেছে এসব খবর পাওয়া মাত্রই বাঘ শিকারের আয়োজন শুরু হতো। মসজিদে দেওয়া হতো ঘণ্টা। দলে দলে লোকে মসজিদে ছুটতো। জাল ধুয়ে সাফ করা হতো। কুচ বল্লম (জাটা) দা, খুন্তি, কুঠার সব শান দেওয়া হতো। তারপর দিন ঠিক করে দোয়া মাহফিল। হিন্দুরা পুজো ও ভগবানের কাছে আশির্বাদ চেয়ে, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা পাহাড়ের দিকে বাঘ শিকারে রওয়ানা দিত। এভাতে ১৬টি পঞ্চায়েতের হাজার হাজার মানুষ জালজাটা নিয়ে পাহাড়ে একত্রিত হতো। তখন পাহাড়ে উৎসব ভাব চলে আসত। রীতিমতো বাজার বসে যেত। তবে লোকজন গাছপালা ও পরিবেশের প্রচুর ক্ষতি সাধন করত আগুন জ্বালিয়ে, হাঁক দিয়ে, ঢোল বাজিয়ে, হু হু আদিম চিৎকার, যত্রতত্র জলবিয়োগ ও পুরিষ প্রক্ষালন করে। হিনাই নগর, পাখিয়ালা, অজমীর, সাতকরাকান্দি, সুজানগর, এরকম ১৬টি পঞ্চায়েতের নিজস্ব জাল ছিল। বাঘ যেখানে লুকিয়ে থাকত শিকারিরা তাকে ‘ধুর’ বা ‘লুৎ’ বলে। এই লুতের মধ্যে শিকারিরা জাল পেতে লতাপাতা দিয়ে ঢেকে রাখত। জালের নিকট সাহসী ও সাবধানী ৫/৭ জন শিকারি সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকত। বাঘ সব সময় পিনপতন নিরবতার মধ্যে বসবাস করে। দূর থেকে অন্যদের হৈ হুল্লোর ও ঢাক ঢোলের শব্দে বাঘ লুতে পালাতে গিয়ে শিকারিদের জালে ধরা পড়ত। আবার গড় বেঁধে ও বাঘ ধরা হতো। গড়ের মধ্যে ছাগল দিয়ে রাখা হতো। ছাগলের চিৎকারে বাঘ এলে শিকারি জাল দিয়ে বাঘ ধরে ফেলত। তারপর কিছুদিন অভুক্ত রেখে, বাঘের সাথে মজা করে, বর্শা দিয়ে খুঁচিয়ে বাঘকে মেরে ফেলা হতো। যাদের জালে বাঘ ধরা পড়ত, শুধু তারাই বাঘ মারার মূল হকদার। বাঘকে মেরে ফেলার পর কাঁধে নিয়ে গ্রামে গঞ্জে সবাইকে দেখানোও হতো। এইসব বাঘ শিকার দেখতে জেলা সদর থেকে এসডিওরাও আসতেন। বাঘ শিকারের শৈশব স্মৃতি হিসেবে বিশিষ্ট প্রবাসী বিজ্ঞানী ড. আতাউল করিম এক সাক্ষাতকারে বলেছেন- ‘সে সময় আমাদের এলাকায় বছরে তিন থেকে চারটি বাঘ ধরা পড়ত। আর বাঘ ধরা মানে স্কুল ছুটি হয়ে যাওয়া। স্কুল ছুটি মানে একসঙ্গে তিন চারদিন। পাহাড়ি এলাকায় গড় বেঁধে বাঘ ধরা হতো।... উল্লেখ্য ড. আতাউল করিমের গ্রামের বাড়ি পাথারিয়া পাহাড় থেকে প্রায় ৬ মাইল দূরে অবস্থিত। ৮২ বছর বয়সের বাঘ শিকারি হাজী মতছিম আলী মতই মেম্বার সাহেবের সাথে আমাদের আলাপ হয়। তিনি প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি বাঘ ও ৩০০ থেকে ৪০০ হরিণ শিকার করেছেন। তার জীবনের স্মৃতিময় ঘটনা হলো রয়েল বেঙ্গল টাইগার শিকার করা। ১৩৬৬ বাংলার ২২ জৈষ্ঠ্যের এই দিনে তাদের কাছে খবর এল কেরামত নগরে বাঘ দেখা গেছে। ব্যাস, আর কোন কথা নেই। বাঘ শিকার তার রক্তের সাথে মিলিত একটা নেশা। তিনি তার সাহসী গুরু নেছার আলীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। গাছে মাঁচা বেঁধে বাঘের আগমনের জন্য অপেক্ষা করেন। দু’চোখে টর্চলাইটের মতো আলো জ্বালিয়ে বাঘ এল। এরপর বাঘকে তারা গুলি করে মেরে ফেলেন। এই বাঘটি লম্বায় ছিল সাড়ে সাত হাত। তার জীবনের আরেকটি ভয়ঙ্কর ঘটনা হল, একবার কেছরিগুল এলাকায় গড় বেঁধে বাঘ শিকার করা হলো। রাত্রে গড়ের মধ্যে বাঘকে আটকে রাখা হয়। কিন্তু দিনের বেলা বাঘ গড় ভেঙ্গে ফেলে। উপস্থিত লোকজন ভয়ে সবাই পালিয়ে যায়। শুধু গুরু নেছার আলী আর আমি বাঘের সাথে মোকাবিলা করি। বাঘ তখন নেছারের একহাত কামড়ে ধরে আর নেছার আলী অন্য হাতে বাঘের জিহ্বা টেনে ধরে। তারপর গুলি করে আমি বাঘটাকে মেরে ফেলি। এই ঘটনায় নেছার আলী শারীরিকভাবে আক্রান্ত হোন। তাকে ভালো চিকিৎসার জন্যে আসামে পাঠানো হয়। তৎকালীন সরকার তাকে একটি বন্দুক উপহার দেন। এরকম আরও বাঘ শিকারিরা হলেন- পাখিয়ালার- বশির আলী, আইউব আলী, জোনাব আলী, রঈছ আলী, মুছব্বির আলী, হিনাইনগরের বাট্রিসত্তর, নিজবাহদুর পুরের আবজল। দরগা বাজারের জওয়াইদ আলী, মুছিম আলী, নজীব আলী প্রমুখ। বাঘ শিকার নিয়ে একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা এরকম স্থানীয় কেছারিগুলের আফজাল মিয়া শিকারকৃত মৃত প্রায় বাঘের মুখে দয়াপরবশ হয়ে পানি দিলে, বাঘ তার শরীরে প্রাণ ফিরে পায় এবং আফজাল মিয়াকে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলে। এতে পুরো এলাকায় হায় হায় রব ওঠে। পরে আফজাল মিয়াকে নিয়ে বাংলা পুঁথি রচিত হয়। বাঘ শিকারের এইসব অদ্ভুত তথ্য জানান স্থানীয় ফখরুল ইসলাম সোহাগ ও নজীব আলী। পাথারিয়া পাহাড় এখন আগের মতো নেই। এখন এখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। ট্রাক ও নানান জাতের গাড়ি চলছে। পাহাড়ের শান্ত পরিবেশ, পাখিদের গুঞ্জন নানান রকমের গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ট্রাক্টর ও টেম্পু ইঞ্জিনের শব্দের সঙ্গে ছাড়ছে বিষাক্ত ধোঁয়া। পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে। চলছে পুকুর খনন। দালান উঠছে। দোকান পাট বসেছে, বসেছে ইটভাটা আর করাতকল, বন ছাই হচ্ছে ইটলোকার জ্বালানী হয়ে। অবাধে চলছে বৃক্ষ নিধন। দেখার লোক আছে। হায়! ঠেকাবার কেউ নেই।